আইআরআইয়ের জরিপ
মানুষ ভাবছে, বাংলাদেশ ভুল পথে এগোচ্ছে
ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে এক জনমত জরিপ চালিয়েছে। এই জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে ৮ আগস্ট তাদের ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর)। শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রতিষ্ঠান রাজনীতি, নির্বাচন, বিদেশনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। বিরোধী পক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে ও জাতীয় সংসদের কয়েকটি আসনের উপনির্বাচন বর্জন করেছে। দলটির দাবি, সরকারের পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। তাদের এই দাবির পক্ষে দলটি আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পায়নি।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমশ বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি, যা সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। আগামী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে শক্তি দেখাচ্ছে। সমর্থকদের জড়ো করে সভা–সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করছে। এমন অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও নির্বাচন ঘিরে মানুষের মত বোঝার জন্য খুব কমই তথ্য–উপাত্ত মিলছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) সাম্প্রতিক একটি জাতীয় সমীক্ষা এবং ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ নিয়ে মানুষের মনোভাবের বিভিন্ন আঙ্গিক প্রকাশ পেয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, অর্থনীতি ও নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষ হতাশ। তবে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসমর্থনকে চাঙা করেছে।
এরপরও একদিকে দেশজুড়ে বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে, অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বিষয়ে ক্ষমতাসীনেরা অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের কৌশলে সাধারণ মানুষকে সংশয়ী বলে মনে হচ্ছে।
মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে
দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষ হতাশ। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে এমন জরিপ করে আসছে আইআরআই। এবারই প্রথম জরিপে অংশ নেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৩ শতাংশ) মানুষ মনে করছেন, বাংলাদেশ ভুল পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এ মনোভাব পোষণ করা মানুষের সংখ্যা প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে করা জরিপের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি।
অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মানুষের মধ্যে এমন মনোভাব বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। জরিপে ‘দেশ ভুল পথে যাচ্ছে’ বলা মানুষদের অর্ধেকই বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাঁরা এমন ধারণা পোষণ করেন। ৫১ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, দেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে নেই। ২০১৯ সালের জরিপের চেয়ে এই হার ৩৫ শতাংশ বেশি।
জরিপে অংশ নেওয়া মাত্র ২৬ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, আগামী বছরে দেশের অর্থনীতি এখনকার তুলনায় ভালো হতে পারে। আর ৩৬ শতাংশ মনে করছেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এফজিডিতে অংশ নেওয়া অনেকেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের পরিবারের ওপর পড়া বিরূপ প্রভাব নিয়ে নিজেদের কষ্টের কথা জানিয়েছেন।
ময়মনসিংহে এফজিডিতে অংশ নেওয়া একজন নারী বলেন, ‘আমার স্বামীর বেতন বাড়েনি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে, প্রতিদিনই বাড়ছে। এতে সংসার চালাতে গিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’
দেশের রাজনীতি নিয়েও জরিপে অংশ নেওয়া মানুষদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ বেড়েছে। কমসংখ্যক মানুষ মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৫ শতাংশ রাজনীতি নিয়ে তাঁদের মতামত প্রকাশে ভয় পেয়েছেন।
খুলনায় এফজিডিতে অংশ নেওয়া একজন নারী বলেন, ‘আপনি যদি রাজনীতি নিয়ে কিছু বলেন, আমি যদি রাজনীতি নিয়ে নিজের কথাগুলো বলি, আমার ভয় আছে যে এ জন্য আমাকে মরে যেতে হতে পারে।’
সাধারণ মানুষ মনে করছেন, রাজনৈতিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের স্বার্থরক্ষা করছে না। জরিপে ৩৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতিকে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। জরিপে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনের বেশি মনে করছেন, সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান চান এক–তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারী।
এমনকি জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের মধ্যে নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়েও নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। ৬২ শতাংশ মনে করছেন, নাগরিক সমাজ রাজনৈতিক অভিজাতদের স্বার্থ সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ দৃঢ়, লাভ হচ্ছে বিএনপির
সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশের রাজনীতি–অর্থনীতি নিয়ে হতাশা বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলছে। তবে সেটা এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে দুর্বল করতে পারেনি। জরিপে অংশ নেওয়া ৭০ শতাংশ মনে করেন, শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে বেশ ভালো করছেন। সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে শিক্ষার উন্নয়ন—সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পেয়েছে।
খুলনায় এফজিডিতে অংশ নেওয়া একজন নারী বলেন, ‘আমি যদি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, সড়ক, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো তিনি (শেখ হাসিনা) অনেক কিছু করেছেন।’
এরপরও জরিপে অংশ নেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির কারণে সরকারের কর্মকাণ্ডে হতাশ। ঢাকায় এফজিডিতে অংশ নেওয়া একজন নারী বলেন, ‘কোনো চাকরি পাওয়া এতটাই কঠিন যে আপনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়া একজনকে রিকশা চালাতেও দেখতে পারেন।’
অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে হতাশা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জরিপে অংশ নেওয়া ৬৩ শতাংশ মানুষের সমর্থন পেয়েছে বিরোধী দল, যা ২০১৯ সালে ছিল ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের জনসমর্থনের (৭০ শতাংশ) তুলনায় বিরোধীদের জনসমর্থন মাত্র ৭ শতাংশ কম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সমর্থন, বর্জন নয়
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিতর্ক নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে। বিএনপির দাবি, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের। এই দাবি সামনে রেখে সাম্প্রতিক সব নির্বাচন বর্জনের কৌশল বেছে নিয়েছে দলটি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের আগপর্যন্ত এ কৌশল মেনে চলতে চায় তারা। ২০১১ সালে হাইকোর্টের রায়ে এই ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দক্ষতার সঙ্গে তদারক করতে সক্ষম। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
এখন পুরো বাংলাদেশ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আইআরআইয়ের জরিপে অংশ নেওয়া ৯২ শতাংশ জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে তাঁদের ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে ৪৪ শতাংশ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা দরকার। আর ২৫ শতাংশের মতে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। ২৫ শতাংশ মনে করছেন, পরবর্তী নির্বাচনের সময় দুই দলের সমন্বয়ে ‘ঐক্য সরকার’ গঠন করা যেতে পারে।
সাধারণ মানুষের অনেকেই মনে করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁরা ভোট দিতে চান না, তাঁদের ৫৫ শতাংশ আগের নির্বাচনে কারচুপির উদাহরণ দেখিয়েছেন।
রংপুরে এফজিডিতে অংশ নেওয়া একজন পুরুষ ভোটার বলেন, ‘যদি ক্ষমতাসীন সরকার নিরপেক্ষতা দেখাতে পারে, তাহলে আমি ভোট দেব। তা না হলে আমি ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকব। এর আগে আমি ভোটকেন্দ্র কারচুপির ঘটনা চোখের সামনে দেখেছি। তাই আসন্ন নির্বাচনে আমার ভোট আদতে কোনো গুরুত্ব রাখবে কি না, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।’
তা সত্ত্বেও জরিপে অংশ নেওয়া ৫৬ শতাংশ মনে করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করা না হলেও বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। এফজিডিতে বিএনপির অনেক সমর্থক বলেছেন, দলটির সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত, ভোটের লড়াইয়ে নামা উচিত। ময়মনসিংহে এফজিডিতে অংশ নেওয়া একজন নারী বলেন, ‘জনগণের উদ্দেশে বিরোধী দলগুলোর এই বার্তা দেওয়া উচিত যে এমন কেউ আছে, যারা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে।’
২০২৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব
আগামী সাধারণ নির্বাচনের আর ছয় মাসেরও কম সময় বাকি। এ সময় আইআরআইয়ের জরিপ থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে, রাজনীতি, অর্থনীতি, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে দেশের মানুষের হতাশা বেড়েছে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। একটি বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন গণতন্ত্রের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা ফেরানোর প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করতে পারে। গণতান্ত্রিক অসন্তোষ বাড়াতে পারে। সেই সঙ্গে কয়েক দশকের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য থেকে দেশের মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ডেভিড হুগস্ট্রা: ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) প্রোগ্রাম ম্যানেজার।
জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড: ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এবং ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
অনুবাদ: অনিন্দ্য সাইমুম
সংশোধনী
ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা আইআরআইয়ের জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সিএফআর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোর পৃষ্ঠা ৫-এ ‘মানুষ ভাবছে, বাংলাদেশ ভুল পথে এগোচ্ছে’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। প্রথম এতে ‘কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে’ লাইনে ভুলে ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ শব্দগুচ্ছ লেখা হয়েছে। মূলত হবে, ‘কমসংখ্যক মানুষ মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।’ পরে এটি সংশোধন করা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।
বা.স