আওয়ামী লীগ আমলে দেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি ডলারে, ব্যয় বেশি ৮ হাজার কোটি টাকা
ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে এখন ১২০ টাকা।
লাভবান বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা। মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে মানুষ।
বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশি ব্যবসায়ীদের মালিকানায়; কিন্তু সরকার তাঁদের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে মার্কিন ডলারে। শুধু ডলারে চুক্তির কারণে বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে সরকারকে।
বাড়তি ব্যয়ের কারণ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। আড়াই বছর আগে দেশে মার্কিন ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। বাড়তে বাড়তে তা এখন দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকায়। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা লাভবান হচ্ছেন। বিপাকে পড়েছে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার আবার সেই বাড়তি ব্যয় সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়েছে।
বিগত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। তারপরও বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে নিয়মিত হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তারা মানুষের করের টাকা থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।
দেশি মালিকানায় ও দেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হয়েছে ডলারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদেশি বিনিয়োগ আছে, তাদের চুক্তিতে ডলারে বিল হিসাবের বিধান যৌক্তিক। তবে যাঁরা দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, ডলারের দাম ওঠানামার সঙ্গে তাঁদের বিনিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ক্ষেত্রে হিসাব টাকায় করা যেতে পারে।
তবে খাত–সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন, ব্যবসায়ীরা এখন বাড়তি মুনাফা করছেন। বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ শোধ হয়ে গেছে। তাই এখন ডলারের বদলে টাকায় কেন্দ্রভাড়া হিসাব করা উচিত। তবে এটি সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যই করতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের কোনো বৈষম্য করা ঠিক হবে না। যাঁরা নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছেন, তাঁদের অন্যভাবে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা লাভবান হচ্ছেন। বিপাকে পড়েছে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার আবার সেই বাড়তি ব্যয় সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়েছে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করে দরপত্র ছাড়া একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। দরপত্র না হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে হয়নি। এ আইনের অধীন করা চুক্তি নিয়ে আদালতে যাওয়া যায় না। ফলে এটি দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। সীমিত সময়ের জন্য আইনটি করেও তার মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়মুক্তি আইনের অধীন কোনো ক্রয়চুক্তি করছে না। কিন্তু এর আগেই বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় অনেক বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র কাজে না লাগলেও কেন্দ্রভাড়া দিতে হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে পিডিবির খরচ হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বেসরকারিতে চুক্তি ডলারে
সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ক্রয়চুক্তি করে পিডিবি। দেশে বর্তমানে ১৪৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আছে। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ৬২টি। যৌথ উদ্যোগে চালু বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি। আর বাকি ৮০টি বেসরকারি খাতে নির্মিত।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি খাতের ৯০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পুরোটাই ডলারে হিসাব করে পরিশোধ করা হয়। ডলারের দাম যত বাড়ে, ততই লাভবান হন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা। আর সরকারের খরচ বাড়ে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেই ডলারে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক রীতি। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ হয় আমদানিতে। পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে দরপত্র ছাড়া। সেখানে আগ্রহ বাড়ানো বা প্রতিযোগিতার কোনো বিষয়ই ছিল না। অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা দেশি ব্যবসায়ীদের হাতে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সব যন্ত্রপাতি শুরুতেই আমদানি করা হয়। তাই পরবর্তী সময়ে সেসবের ব্যয় বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি খাতের ৯০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পুরোটাই ডলারে হিসাব করে পরিশোধ করা হয়। ডলারের দাম যত বাড়ে, ততই লাভবান হন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা। আর সরকারের খরচ বাড়ে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলে মূলত দুটি অংশ থাকে। এর একটি স্থায়ী খরচ, যা কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) নামে পরিচিত। আরেকটি অংশ জ্বালানি ও পরিচালন খরচ, যা জ্বালানির দামের ওপর ভিত্তি করে বাড়ে বা কমে। কেন্দ্রভাড়ার অংশটি চুক্তিতে নির্ধারিত থাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও এটি দিতে হয়, না করলেও এটি দিতে হয়।
কেন্দ্রভাড়ার বিলে দুটি অংশ—স্থির ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। স্থির ব্যয়ের মধ্যে মূলত জমির মূল্য, ব্যাংকঋণের সুদ ও আসল ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত ব্যয় হেরফেরের সুযোগ নেই। রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে মেরামত, বেতন-ভাতাসহ পরিচালন খরচ, বিশেষজ্ঞ খরচ, বিমা ইত্যাদি থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যয় কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।
পিডিবির কর্মকর্তারা হিসাব করে দেখিয়েছেন, দেশি মালিকানার ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দামে কেন্দ্রভাড়ার স্থির ব্যয়ের অংশটি ডলারের বদলে টাকায় ধরা হলে সরকারের ৮-১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পিডিবির সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এভাবেই বিদ্যুৎ বিল হিসাব করা হয়।
দেশি উদ্যোক্তরা দেশি অর্থে জমি কিনে এবং দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। মানে হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে সব খরচই হয়েছে টাকায়। কিন্তু বিল পরিশোধ করা হচ্ছে ডলারে হিসাব করে।
পিডিবির কর্মকর্তারা হিসাব করে দেখিয়েছেন, দেশি মালিকানার ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দামে কেন্দ্রভাড়ার স্থির ব্যয়ের অংশটি ডলারের বদলে টাকায় ধরা হলে সরকারের ৮-১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পিডিবির সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এভাবেই বিদ্যুৎ বিল হিসাব করা হয়।
সৌরচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে সব চুক্তিই ডলারে করা হয়েছে। নতুন মহাপরিকল্পনা অনুসারে সৌরচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে জমির খরচ অনেক। জমি কেনা হয় টাকায়। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জমির দাম ডলারে ধরে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দর নির্ধারণের যুক্তি নেই।
পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম ৭ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, পিডিবির খরচ সাশ্রয়ে সব কিছুই যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। খরচ কমানোই এখন অগ্রাধিকার। তবে চুক্তি সংশোধনের ক্ষেত্রে নানা শর্তের বিষয় আছে। এগুলো দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া চুক্তি পর্যালোচনায় সরকার গঠিত পর্যালোচনা কমিটি কাজ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গত সরকারের সময় বিশেষ আইনে করা সব চুক্তি পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি করেছে। সূত্র জানিয়েছে, কমিটি প্রাথমিকভাবে ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য নিয়েছে। সেই তথ্য যাচাই করার পর সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য চেয়েছে তারা।
‘যৌক্তিকতা নেই’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশে বিদ্যুৎ–সংকট ছিল চরমে। সে সংকট দূর করার জন্য দায়মুক্তি আইনে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমতি দেওয়া হয়। সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের নেতা ও বিভিন্ন দেশ বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমতি পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট পুঁজি করে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ খাতে দেশ ও মানুষের স্বার্থবিরোধী এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থের অনুকূলে অনেক চুক্তি করেছে। তারা বিদ্যুৎ খাতকে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে, যা পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি দিতে হচ্ছে খাতটিকে। তারপরও জ্বালানির অভাবে লোডশেডিংয়ে ভুগতে হয় মানুষকে।
ডলারের দাম ওঠানামার সঙ্গে যেসব খরচের সম্পর্ক নেই, সেটা ডলারে হিসাব করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পিডিবির এখন খরচ হয় প্রায় ১১ টাকা। এখন তারা এটি পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করছে ৭ টাকা ২ পয়সায়। ফলে বিপুল লোকসান হচ্ছে সংস্থাটির। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম ওঠানামার সঙ্গে যেসব খরচের সম্পর্ক নেই, সেটা ডলারে হিসাব করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, আসলে দরপত্র ছাড়া দুর্বল চুক্তি করে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে পিডিবি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় পিডিবির ক্ষতি আরও বেড়েছে। বৈষম্যমূলক এসব চুক্তি পর্যালোচনা করে পিডিবির ক্ষতি দূর করার ব্যবস্থা করতে পারে সরকার।