জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ক্যানসার রোগীর চিকিৎসার জন্য দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। সারা দেশের দরিদ্র রোগীরা দুরারোগ্য এ রোগের চিকিৎসা নিতে এখানে আশা নিয়ে আসেন। এখানে কম মূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার কথা। কিন্তু কম মূল্যে তো দূরের কথা, ক্যানসার রোগীরা এখানে রেডিওথেরাপিও পাচ্ছেন না। অর্থাৎ হাসপাতালটি নিজেই অসুস্থ। দীর্ঘ সময় ধরে ভুগছে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর মতো।
কোনো দিন শোনা যায়নি, গাড়ি নষ্ট থেকেছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ভ্রমণ বন্ধ আছে। তা হলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ক্যানসার হাসপাতালের যন্ত্র নষ্ট পড়ে থাকবে কেন? তাঁরা জানেন, জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানে যন্ত্র অচল হয়ে পড়ে আছে। কারণ পরিষ্কার। তাঁরা পরোয়া করছেন না।
মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের ছয়টি রেডিওথেরাপি যন্ত্র নষ্ট। এর মধ্যে চারটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র, দুটি কোবাল্ট যন্ত্র। ছয়টি যন্ত্র এক দিনে নষ্ট হয়নি। সময়ে সময়ে নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হওয়ার কথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানে, জানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দেশের কিছু সরকারি হাসপাতালে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী চিকিৎসা নিয়েছেন বা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভর্তি আছেন, এমন খবর মাঝেমধ্যে শোনা যায়। কিন্তু তাঁদের কেউ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বা ভর্তি আছেন, এমন শোনা যায় না। অনেকে মনে করেন, এ কারণে ক্যানসার হাসপাতালের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের মনোযোগ কম।
সমাজের প্রান্তিক, দরিদ্র, ক্ষমতাহীন মানুষ এখানে ধারকর্জ করে আসেন, অনেকে জমি-গরু বা শেষ সম্বল বিক্রি করে আসেন। এসে তাঁদের ঘুরতে হয় রেডিওথেরাপির সিরিয়াল পাওয়ার জন্য। অনেকে দালাল ধরেন। অনেকে সুবিধা করতে পারেন না। তিন দিন আগে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে পটুয়াখালীর এক নারীর কথা হয়েছিল। আট মাস ঘুরে তিনি রেডিওথেরাপির দিন পেয়েছিলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে সব যন্ত্র নষ্ট।
ওই নারীর সঙ্গে যখন এই প্রতিবেদকের কথা হয়, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম উত্তরবঙ্গে সফরে ছিলেন। যত দূর জানা যায়, তাঁরা বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর সফর করেছেন। তাঁদের সফর নিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘দেশের প্রান্তিক হাসপাতালগুলোতে সরেজমিন পরিদর্শন করেছি, রোগীদের সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান কথা বলেছি।
মেশিন কয়টি আছে, কয়টি নষ্ট, কী কারণে নষ্ট, কোন চিকিৎসকেরা ডিউটি ঠিকভাবে করেন, কারা করেন না—এসব নিজে উপস্থিত থেকে তালিকা করে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
মন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০০ গজের মধ্যে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ৫ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দুজনই ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তখন পাঁচটি যন্ত্র নষ্ট ছিল। এর কয়েক দিন পর নষ্ট হয় আরেকটি যন্ত্র।
শুধু রেডিওথেরাপির যন্ত্র নষ্ট, তা নয়। জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানে এক্স-রে হয় না; এমআরআই যন্ত্র নষ্ট থাকে বছরের বেশির ভাগ সময়ে। জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ক্যানসার চিকিৎসার অনেক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এখানে হয় না। জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক, প্রশাসনের একাধিক ব্যক্তি, একাধিক সাবেক অধ্যাপক বলেছেন, এ অবস্থা চলছে বছরের পর বছর।
অমনোযোগ, নজরদারির অভাব, দায়িত্বহীনতা, জবাবদিহির ঘাটতি, অনিয়ম, দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানটিকে এ পর্যায়ে এনেছে। একজন জনস্বাস্থ্যবিদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ক্যানসার হাসপাতালটি ক্যানসারে আক্রান্ত।’