ছাত্র-জনতার আন্দোলন: চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আহতরা
কারও হাত, কারও পা কাটা পড়েছে। স্প্লিন্টারের আঘাতে কারও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেছে। গায়ে অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে অনেকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
সাভার প্রেসক্লাবের অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন মঞ্জয় মল্লিক (১৮)। পরিচিতজনেরা তাঁকে চটপটে ছেলে হিসেবে চিনত। সেই ছেলে এখন চুপচাপ। গত ৫ আগস্ট বিকেলে প্রেসক্লাবের ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন। দুপুরের দিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। বিকেলে সাভার প্রেসক্লাবসহ আশপাশের এলাকায় হামলা ও ভাঙচুর শুরু হয়। ক্লাবের অদূরে একটি স্থানে আশ্রয় নেন মঞ্জয়। পুলিশের এক সদস্য তাঁকে পালিয়ে যেতে বলেন। একপর্যায়ে পুলিশের আরেক সদস্য তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। প্রথমে তাঁকে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডান হাতে গুলি লাগায় চিকিৎসকেরা কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলেন।
মঞ্জয়ের মা জ্যোৎস্না মল্লিক সাভার কলেজে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন। থাকেন সাভারের পার্বতীনগর এলাকায় এক কক্ষের টিনের একটি ভাড়া ঘরে। সংসারে আর্থিক অনটন লেগেই আছে। এর মধ্যে ছেলের চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। তাঁরা সরকারি কোনো সহায়তা পাননি।
চিকিৎসকেরা বলছেন, আহত এই মানুষগুলোর দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা দরকার। কিন্তু টানাটানির সংসারে তাঁদের চিকিৎসা অনেকটা অনিশ্চিত। পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত এই মানুষগুলোর বেদনাতুর কাহিনি জানা গেল।
মঞ্জয় বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন দিন চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, কৃত্রিম হাত সংযোজনের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও মঞ্জয়ের জীবন স্বাভাবিক করা সম্ভব।
মঞ্জয় মল্লিক ও তাঁর পরিবারের মতো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় রয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত অনেক ছাত্র, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, দিনমজুর, সাধারণ মানুষ ও তাঁদের পরিবার। তাঁদের কারও হাত কাটা গেছে, কারও পা। কেউ চোখ হারিয়েছেন। কারও এক চোখের আলো নিভে গিয়ে, অন্য চোখেও কম দেখছেন। তাঁদের বেশির ভাগই চিকিৎসার জন্য সরকারি কোনো সহায়তা এখনো পাননি বলে জানিয়েছেন।
চিকিৎসকেরা বলছেন, আহত এই মানুষগুলোর দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা দরকার। কিন্তু টানাটানির সংসারে তাঁদের চিকিৎসা অনেকটা অনিশ্চিত। পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত এই মানুষগুলোর বেদনাতুর কাহিনি জানা গেল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুরুতর আহত তিন শতাধিক ব্যক্তি এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এসব রোগীর চিকিৎসা দিতে যুক্তরাজ্য ও চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল ঢাকায় এসেছে। চোখে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্যও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আসবেন।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের সহায়তা প্রদানের জন্য নীতিমালা করা হয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে আঘাতের কারণে ওই সময় বা পরবর্তী সময়ে শহীদ ব্যক্তির আইনসম্মত ওয়ারিশেরা সরকারের সহায়তা পাবেন। একই সময়ে আহত ও স্থায়ীভাবে অক্ষম ব্যক্তি এই সহায়তার আওতায় আসবেন। মেডিকেল বোর্ড কোনো আহত ব্যক্তিকে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা দেওয়ার সুপারিশ করলে তিনি চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। চিকিৎসা সহায়তার জন্য প্রত্যেকের একটি স্বাস্থ্য কার্ড থাকবে।
নীতিমালার পাশাপাশি হতাহত ব্যক্তিদের একটি খসড়া তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আট বিভাগে মোট ১৮ হাজার ২৪৭ জন আহত ব্যক্তি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। নিহত হয়েছেন ৬২২ জন। প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন ৫২৫ জন। এ ছাড়া চোখে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন ৬৪৭ জন।
আহত এই মানুষদের চিকিৎসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. আবদুল মুনঈম প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দফায় চিকিৎসা শেষে যাঁরা এখন বাড়িতে আছেন, তাঁদের ফলোআপ চিকিৎসার প্রয়োজন হলে নিকটের হাসপাতাল থেকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা নিতে পারেন। এ ছাড়া কারও উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে বা আর্থিক সহযোগিতা লাগলে স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির হেল্পলাইন নম্বরে (০১৮১৮-২৭৯২১৭ ও ০১৪০০-৭২৮০৮০) যোগাযোগ করতে পারেন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এ পর্যন্ত ৩০ থেকে ৪০ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে বলে জানান আবদুল মুনঈম। স্বাস্থ্য কার্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। খুব দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
গলায় আটকে থাকা সেই গুলি নিয়েই আবুল হাসান এক সপ্তাহ ধরে ফাজিল প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। খাওয়ার সময় সমস্যা না হলেও বিছানায় শুতে গেলে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠেন হাসান। তিনি উপজেলার চর চান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চর চান্দিয়া গ্রামের ফল ব্যবসায়ী এনায়েত উল্যাহর ছেলে। ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষের ছাত্র হাসান।
গলায় স্প্লিন্টার নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন হাসান
৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে আহত হন ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্র আবুল হাসান ওরফে শাহীন (২১)। একটি ছররা গুলি বিদ্ধ হয় তাঁর গলায়। জেলা সদর হাসপাতাল থেকে শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েও গলা থেকে সেই গুলি বের করা যায়নি। গলায় আটকে থাকা সেই গুলি নিয়েই আবুল হাসান এক সপ্তাহ ধরে ফাজিল প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। খাওয়ার সময় সমস্যা না হলেও বিছানায় শুতে গেলে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠেন হাসান। তিনি উপজেলার চর চান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চর চান্দিয়া গ্রামের ফল ব্যবসায়ী এনায়েত উল্যাহর ছেলে। ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষের ছাত্র হাসান।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মো. মোশাররফ হোসেনের বরাত দিয়ে আহত হাসান বলেন, এই মুহূর্তে গলায় অস্ত্রোপচার করলে রগ কাটতে হবে। এতে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। কয়েক মাস পর ভালো কোনো হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ছেলের চিকিৎসার জন্য সরকারি কোনো সহায়তা পাননি উল্লেখ করে এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আমার পাঁচ ছেলে। আবুল হাসান তৃতীয়। সামান্য ফলের দোকান করে ছোট দুই ছেলেসহ পাঁচজনের খাবার জোগাড় করা অনেক কষ্ট হয়ে যায়। টাকার অভাবে ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছি না। ছেলে টিউশনি করে নিজের ওষুধ খরচ সামাল দিচ্ছে। এটা আমার জন্য অনেক লজ্জার।’
জুনায়েদের এক পা কাটা পড়েছে
৫ আগস্ট দুপুরে শাহবাগ ও গণভবন ঘেরাও করার কর্মসূচিতে যোগ দিতে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে রওনা হন হাফেজ জুনায়েদ আহমেদ (২৫)। প্রথমে রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যান। কোনো বাধা পাননি। কাজলায় পৌঁছালে পুলিশ অতর্কিতে হামলা চালায়। বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। অনেকক্ষণ পড়ে ছিলেন। সহপাঠীরা উদ্ধার করে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে অস্ত্রোপচার করে পা কেটে ফেলতে হয়। জুনায়েদ কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।
কোরআনে হাফেজ হয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের ও পরিবারের খরচ চালাতেন। অভাব-অনটনের সংসারে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় ছেলেকে নিয়ে বড় আশা ছিল মা–বাবার।
সরকারি কোনো সহায়তা পাননি জানিয়ে জুনায়েদের বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি নিজে ২২ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছি (পক্ষাঘাতগ্রস্ত)। আমার একটাই ছেলে। এই ছেলেটা আমার ভরসার জায়গা। কিন্তু হঠাৎ কী হয়ে গেল! আমার সকল আশা-ভরসা শেষ। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’
আমার পাঁচ ছেলে। আবুল হাসান তৃতীয়। সামান্য ফলের দোকান করে ছোট দুই ছেলেসহ পাঁচজনের খাবার জোগাড় করা অনেক কষ্ট হয়ে যায়। টাকার অভাবে ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছি না। ছেলে টিউশনি করে নিজের ওষুধ খরচ সামাল দিচ্ছে। এটা আমার জন্য অনেক লজ্জারএনায়েত উল্যাহ
বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন দলিল
আন্দোলনকারীদের দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচার গুলি চালিয়েছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট দলিল উদ্দিনের (৩৫) চোয়ালের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ভেঙে যায় দাঁত ও মাড়ি। ছিঁড়ে যায় জিহ্বা। সেই থেকে মুখে খাওয়া ও কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন এই যুবক। এক মাস ধরে ইশারায় ও কাগজে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করছেন তিনি।
দলিল উদ্দিনের অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মো. আবদুল হান্নান বলেন, ‘মুখের ভেতরে বুলেট ঢুকে বড় ধরনের ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে, যা রিপেয়ার করা হয়েছে। একটা সময় পর দলিল উদ্দিন কথাও বলতে পারবেন। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন।’
দলিল উদ্দিনের বাড়ি চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দশমীপাড়ায়। ২০২২ সালে ছোট পরিসরে গার্মেন্ট পণ্যের যৌথ ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী সিনথিয়া আরমিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। স্বামী-স্ত্রী উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের ফায়দাবাদে আট বছর ধরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন।
দলিলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর বাবা মো. নূর উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক মাস ধরে দলিলের চিকিৎসা চালাতে তিন লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। নিজেদের সঞ্চিত ও ধারদেনা করে এত দিন চিকিৎসা চালানো হয়েছে। বাকি চিকিৎসা কীভাবে চলবে, জানেন না এই বাবা।
টাকার অভাবে ছেলের মাথা ও থুতনি থেকে গুলি বের করতে পারছি না। চোখেরও নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হবে। সে জন্যও অনেক টাকার প্রয়োজন। চিকিৎসা করাতে না পারলে ছেলের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।ইয়ামিনের মা রোকেয়া বেগম
মাথায় গুলি নিয়ে যন্ত্রণায় ইয়ামিন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার বিজয়নগর সড়ক এলাকায় ১৯ জুলাই বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ইয়ামিন শেখ (১৭)। সেদিন পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি বিদ্ধ হয়েছিল ইয়ামিনের ডান চোখ, মাথা ও থুতনিতে। চিকিৎসক বলেছেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে থুতনি ও মাথায় অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করতে হবে।
ইয়ামিন ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পূর্ব আগানগর এলাকার নীরব শেখের ছেলে। সে আগানগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। বছরখানেক ধরে সে আগানগর এলাকায় ঝুট কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে। ১৯ জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয় সে। পুলিশের ছোড়া সাতটি গুলি ইয়ামিনের শরীরে বিদ্ধ হয়। এখনো মাথায় চারটি গুলি নিয়ে তীব্র যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে সে। ছররা গুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত ডান চোখে দেখতে পাচ্ছে না। ছয় দিন হাসপাতালে ছিল। সরকারি কোনো সহায়তা সে পায়নি।
ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইয়ামিনের মা রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘টাকার অভাবে ছেলের মাথা ও থুতনি থেকে গুলি বের করতে পারছি না। চোখেরও নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হবে। সে জন্যও অনেক টাকার প্রয়োজন। চিকিৎসা করাতে না পারলে ছেলের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।’
দলিলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর বাবা মো. নূর উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক মাস ধরে দলিলের চিকিৎসা চালাতে তিন লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। নিজেদের সঞ্চিত ও ধারদেনা করে এত দিন চিকিৎসা চালানো হয়েছে। বাকি চিকিৎসা কীভাবে চলবে, জানেন না এই বাবা।
দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছেন আজিজুল
নরসিংদীর পৌলানপুর ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার আলিমের শিক্ষার্থী আজিজুল হক। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি টেক্সটাইল মিলে উৎপাদন বিভাগে অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। বেতনের টাকার প্রায় পুরোটাই পাঠিয়ে দিতেন পরিবারের কাছে। আজিজুলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার তেজখালী ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামে। বাবা কৃষক, পাঁচজনের সংসার। গোটা পরিবারই আজিজুলের রোজগারের ওপর নির্ভরশীল।
সেই আজিজুল ১৮ জুলাই বিকেলে নরসিংদীর ভেলানগর এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় দুই চোখ গুলিবিদ্ধ হন। সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাঁর দুই চোখের অস্ত্রোপচার হয়। ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২০ দিন চিকিৎসা নিয়েছেন। সরকারি কোনো সহায়তা পাননি। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া সহায়তা দিয়ে চলছে চিকিৎসার খরচ।
মা ময়না বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ যে সাহায্য করছে, তা দিয়া কোনোমতে সংসার ও পোলার চিকিৎসার খরচ চলতাছে। চোখের চিকিৎসা লইয়া চিন্তায় আছি। চলা কঠিন হইয়া গেছে।’
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ২০ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তাঁর ছেলে। চিকিৎসকেরা ছেলেকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে বলেছেন। ছেলের আয়ে সংসার চলেছে। এখন ছেলের চাকরি নেই। তাঁর নিজের কাজও বন্ধ। এখন সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।রাকিবুলের বাবা মোকলেছুর রহমান
রাকিবুলের চোখেও অন্ধকার
রাকিবুল ইসলামের (২৫) শরীরে ৬৫টি ছররা গুলি লেগেছিল। চিকিৎসার পরও তাঁর ডান চোখ ভালো হয়নি। এখন তিনি ওই চোখে কিছুই দেখতে পান না। বাঁ চোখেও ঝাপসা দেখেন। রাকিবুলের বাড়ি জয়পুরহাট পৌর শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রফেসর পাড়ায়। বাবা মোকলেছুর রহমান খাবার হোটেলের কর্মচারী।
রাকিবুল বলেন, ‘ছয় মাস আগে বিয়ে করেছি। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মেট্রো টেক্সটাইল লিমিটেডে অপারেটর পদে চাকরি করতাম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে আসি। বন্ধুদের সঙ্গে গত ৪ আগস্ট জয়পুরহাট শহরের পাঁচুর মোড়ে আন্দোলনে গিয়েছিলাম। দুপুর ১২টার পর পুলিশের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় আমার শরীরে ছররা গুলি লাগে।’
সরকারি আর্থিক কোনো সহায়তা পাননি উল্লেখ করে রাকিবুলের বাবা মোকলেছুর রহমান বলেন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ২০ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তাঁর ছেলে। চিকিৎসকেরা ছেলেকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে বলেছেন। ছেলের আয়ে সংসার চলেছে। এখন ছেলের চাকরি নেই। তাঁর নিজের কাজও বন্ধ। এখন সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। ছেলের চিকিৎসা করানোর টাকা পাবেন কোথায়, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]