যেখানে শিখবেন বিদেশি ভাষা

যে দেশেই যান না কেন, সেই দেশের ভাষা জানা থাকলে মিলবে চাকরি, সহজ হবে জীবনযাপন। মডেল: লাবণ্যছবি: প্রথম আলো

দেশ থেকে প্রতিবছরই হাজারো শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে বিদেশে যাচ্ছেন। অনেকেই চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ছেন। দেশ নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকাটাও ছোট নয়। কারও পছন্দ জার্মানি, তো কারও পছন্দ যুক্তরাষ্ট্র। আবার অনেকের পছন্দের তালিকায় থাকছে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, ফ্রান্স।

তবে যে দেশেই যান না কেন, সেই দেশের ভাষা জানা থাকলে মিলবে চাকরি, সহজ হবে জীবনযাপন। অবশ্য গুগল, ইউটিউব আর ফেসবুকের যুগে নতুন ভাষা শেখা অনেকটাই সহজ। তবে অভিজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে থেকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ভাষার নির্যাস নিতে চান কেউ কেউ। এ জন্য যেতে হবে ভাষা শিক্ষাকেন্দ্রে। তবেই মিলবে সঠিক পথের সন্ধান।

বিদেশি ভাষাশিক্ষায় পিছিয়ে নেই বন্দরনগর চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা। ইংরেজির পাশাপাশি আগ্রহ বাড়ছে জার্মান ও ফরাসি ভাষাশিক্ষায়। যেমনটা দেশ নির্বাচনে কদর বাড়ছে জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের। প্রতিবছর চট্টগ্রামের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী জার্মান ও ফরাসি ভাষায় তালিম নিচ্ছেন। পাশাপাশি বাড়ছে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা প্রমাণের পরীক্ষা ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টিং সিস্টেমে (আইইএলটিএস) অংশ নেওয়ার সংখ্যা।

ভাষাশিক্ষায় যুক্ত শিক্ষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশগুলোতে পড়তে যাওয়া অথবা কাজের সন্ধান করার জন্য ভাষা শেখার বিকল্প নেই। ভাষা জানা থাকলে সহজে চাকরি পাওয়া যায়। জীবনযাপন হয়ে ওঠে সহজ। এ কারণে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা এসব ভাষা শেখার প্রতি ঝুঁকছেন।

যেখানে শিখবেন জার্মান

২০০৭ সালে চট্টগ্রামের জামালখানে চালু হয় জার্মান ভাষা শেখার প্রতিষ্ঠান ‘ডি স্প্রাখে’। শুরুতে আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। এরপর নানা প্রচার-প্রচারণা ও জার্মানিতে চাকরি ও পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখানে এ-ওয়ান, এ-টু, বি-ওয়ান, বি-টু, সি-ওয়ান, সি- টু-এই ছয় ধাপেই মূলত জার্মান শিক্ষা দেওয়া হয়।

জার্মানি গিয়ে মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিতে এ-ওয়ান ও এ-টু সিলেবাস শেষ করলেই হয় বলে জানান ডি স্প্রাখের কর্ণধার জয়ন্ত চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জার্মানির অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটি এ-ওয়ান পাস করা শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দেয়। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-টুও চায়। তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি-বাকরির জন্য জার্মান জানা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

ডি স্প্রাখেতে জার্মান শিখতে শিক্ষার্থীদের খরচ হবে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। চাকরিজীবীদের খরচ হবে ২১ হাজার ৫০০ টাকা। এই খরচ শুধু এ-ওয়ান ও এ-টু কোর্সের জন্য। এর বাইরে বি-ওয়ান থেকে সি টু পর্যন্ত খরচ পড়বে ২৫ হাজার ২০০ টাকা।

আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে শিখুন ফরাসি

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউনেসকো, ন্যাটো, অলিম্পিক কমিটি, রেডক্রসসহ বিভিন্ন সংস্থার অন্যতম অফিশিয়াল ভাষা ফরাসি। চাকরির বাজারেও এই তামার কদর কারও অজানা নয়। পৃথিবীর ৩৭টি দেশে এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরাও শিখছেন এই ভাষা। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।

১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় চালু হয় ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ’। শুরুতে মাত্র ১০০ শিক্ষার্থী ফরাসি ভাষা শিখতে ভর্তি হন এই প্রতিষ্ঠানে। এরপর শুধুই বেড়েছে এই সংখ্যা। বর্তমানে আলিয়ঁসের অধীনে প্রতিবছর দুই হাজার শিক্ষার্থী ফরাসি ভাষা শিখছেন।

শুধু ভাষা নয়, প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে প্রায় ৩০টি ফরাসি নাটক এই শহরে মঞ্চায়ন করেছে। আয়োজন করেছে বিভিন্ন রকমের প্রদর্শনী ও ফরাসি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১০০ থেকে ২ হাজার, ধীরে ধীরে সংখ্যায় এত শিক্ষার্থী বাড়ার কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক গুরুপদ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাপী ফরাসি ভাষা ছড়িয়ে গেছে। চাকরি, উচ্চশিক্ষা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে সাহায্য করছে এই ভাষা। তাই চাহিদাও বাড়ছে।

আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক—যে কেউ ভাষা শিখতে পারবেন। এ-ওয়ান, এ-টু, বি-ওয়ান, বি-টু, সি-ওয়ান, সি- টু-এই ছয় ধাপেই মূলত ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। এতে ৬ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়বে।

আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ছয় বছর ধরে ফরাসি ভাষা শিখছেন আইনজীবী মোস্তফা মোহাম্মদ এমরান। তিনি জানালেন, ফরাসি চলচ্চিত্র ও নাটক দেখে এই ভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়। পরে তিনি গান শোনা শুরু করেন। ২০১৯ সালের দিকে সিদ্ধান্ত নেন বিস্তৃত পরিসরে ভাষাটির চর্চা করবেন। সে বছরই ভর্তি হন আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এখন তিনি ফরাসি ভাষার সাহিত্য পড়ছেন।

ইংরেজি শিখতে দৌড়ঝাঁপ

ইংরেজি শেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত; ইংরেজি ভাষার প্রচলন। চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য ইনস্টিটিউট রয়েছে। এর বাইরে বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইংরেজি ভাষা শেখানোর কোর্স পরিচালনা করে। এর মধ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিল, এক্সিকিউটিভস কেয়ার, স্পিকারস কাউন্সিল, গ্রে গুজ ইংলিশ একাডেমিসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

আইইএলটিএসের জন্য প্রস্তুতি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরেজিতে দক্ষতা প্রমাণেরও প্রয়োজন পড়ে। প্রথম দিকে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনার জন্য আইইএলটিএস অপরিহার্য ছিল। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য এই কোর্স গ্রহণ করে থাকে। মূলত একজন শিক্ষার্থীর ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা যাচাইয়ে একটি নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি হিসেবে এই পদ্ধতিকে বিবেচনা করা হয়।

আইইএলটিএস পরীক্ষায় সাধারণ চারটি অংশ থাকে। লিসেনিং, রিডিং, রাইটিং ও স্পিকিং—এই চার পদ্ধতিতে ইংরেজির ওপর দক্ষতা যাচাই করা হয়। চারটি অংশে আলাদাভাবে প্রাপ্ত স্কোর গড় করে চূড়ান্ত স্কোর দেওয়া হয়। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে সাধারণত ৭ থেকে সাড়ে ৭ পেতে হয়। তবে সাড়ে ৬-এর কম খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়।

ব্রিটিশ কাউন্সিলে এই কোর্স সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যাবে। তাঁদের ওয়েবসাইট হলো www.britishcouncil.org.bd। এ ছাড়া চট্টগ্রামের এক্সিকিউটিভস কেয়ার, স্পিকারস কাউন্সিলসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এই কোর্স সম্বন্ধে নানা তথ্য দেওয়া হয়। স্পিকারস কাউন্সিলে যোগাযোগ করা যাবে ০১৭৭-২৭২১৪৩২ নম্বরে।

অন্যদিকে গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড এক্সামিনেশন বা জিআরই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার দিকেও আগ্রহী হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর কিংবা পিএইচডি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের জন্য জিআরই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ, মেডিকেল কলেজসহ সম্মান শ্রেণি সমমানের যেকোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী জিআরই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, মানবিক থেকে শুরু করে সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় অনুষদে পড়ুয়ারাও জিআরই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের এডুকেশন টেস্টিং সার্ভিস (ইটিএস) জিআরই পরীক্ষার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করে।

চট্টগ্রামের এক্সিকিউটিভস কেয়ার জিআরই পরীক্ষার আয়োজন করে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে ০১৮১৯-২৯৭৮৬৮ এ নম্বরে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখা যাবে সাত ভাষা

এইচএসসি পাস করে যে কেউ চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি ভাষা শেখার কোর্সে ভর্তি হতে পারবেন। সেখানে জাপানিজ, চায়নিজ, ফারসি, আরবি, ফরাসি, ইংরেজি ও বাংলা (শুধু বিদেশিদের জন্য) ভাষা শেখা যায়। সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা—এ দুই কোর্সের মাধ্যমে ভাষা শেখানো হয়। কোর্সের মেয়াদ এক বছর। খরচ পড়বে ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩৩০ টাকা। ভাষা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।