ঝুপড়িঘরগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, আধা পাকা ঘর ভেঙে পড়েছে, কোনো কোনো ভবনের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে, নারকেলগাছগুলোর মাথা ভাঙা—ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতের পরদিন গিয়ে আমরা দেখলাম এক অচেনা সেন্ট মার্টিনকে।
মোখার আঘাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ সেন্ট মার্টিন। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র বাংলাদেশে শুধু সেন্ট মার্টিনের ওপর দিয়েই গেছে, বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার। বাকিটা গেছে মিয়ানমারের ওপর দিয়ে।
দ্বীপের বাসিন্দা ৯০ বছরের বেশি বয়সী সুলতান আহমেদ প্রথম আলোকে বলছিলেন, সেন্ট মার্টিনে এমন ঝড় কখনো দেখেননি তিনি। জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় মানুষ বেঁচে গেছে। কিন্তু দরিদ্র মানুষের ঘরবাড়ি টিকে নেই।
আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ সেন্ট মার্টিন বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। দ্বীপটিতে ১১ হাজারের মতো মানুষের বাস। গত রোববার দুপুর ১২টার দিকে ঘূর্ণিঝড় মূল আঘাত হানার সময় দ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ হোটেল-রিসোর্টে আশ্রয় নিয়েছিল। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাতাসের গতি কমে। মানুষজন গিয়ে দেখে, তাদের ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।
সেন্ট মার্টিনের সংকট এখন বহুমাত্রিক। সৌরবিদ্যুতের আলো পাওয়া যাচ্ছে না। জেনারেটর চালানোর মতো জ্বালানি তেল নেই। সুপেয় পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। অবশ্য মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরেছে।
টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের পথে স্বাভাবিক নৌ চলাচল গতকাল পর্যন্ত শুরু হয়নি। তবে বেলা তিনটার দিকে আমরা সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে রওনা হই কোস্টগার্ডের একটি উচ্চগতির নৌযানে (হাইস্পিড বোট-এইএসবি-১০)। এই নৌযান সাধারণত ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে পৌঁছায়। তবে সাগর উত্তাল থাকায় আমাদের লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা।
মোখার বিদায়ের ২৩ ঘণ্টা পর আমরা যখন সেন্ট মার্টিনের নৌযান ভেড়ানোর ঘাটের কাছাকাছি, তখন নারকেলগাছের ভাঙা মাথা দেখে দূর থেকেই বোঝা গেল মোখার ধ্বংসচিহ্ন। নারিকেল জিনজিরা নামে খ্যাত দ্বীপটির নারকেলগাছগুলো মোখার আঘাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নামার পরই আমরা দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা শুরু করলাম। দক্ষিণ পাড়া, কোনাপাড়া, উত্তর পাড়া, পূর্ব পাড়া—সব জায়গায় চিত্রটি একই। বিধ্বস্ত বসতবাড়ির মধ্যে কেউ কেউ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, কেউ কেউ ঘরকন্নার উপকরণ কিছু টিকে আছে কি না, খুঁজে দেখছিলেন, কেউ কেউ রাতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতে ঘর কোনোরকমে মেরামতের চেষ্টায় ছিলেন।
দ্বীপের উত্তর পাড়ায় আমরা ঢুকলাম শেখ আবদুল্লাহর বাড়িতে। তাঁর ঘরের টিনের চালা উড়ে গেছে। ভেতরে খাট ও অন্যান্য আসবাব ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। আবদুল্লাহ ব্যস্ত টিনের চালা সারাতে। তিনি বলেন, রোববার বেলা ১১টার দিকে বাতাস বাড়তে শুরু করলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান তিনি। সঙ্গে কোনো কিছু নিতে পারেননি। টিনের চালা উড়ে গিয়ে সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে।
শেখ আবদুল্লাহর বাড়ি থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে একটি বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়িটি সাগর লাগোয়া। ভেতরে সাতটি ঘর তছনছ হয়ে গেছে। বাড়ির বাসিন্দাদের একজন শফিকা আক্তার নিজের ঘর কোনোরকমে মেরামত করে থাকা যায় কি না, সেই চেষ্টা করছিলেন। তিনি বলেন, হঠাৎ ঝোড়ো বাতাস শুরু হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাননি। প্রতিবেশীর পাকা ভবনে তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে দেখছিলেন বহু বছরের বসতঘরের চালা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর প্রশ্ন, চেয়ে চেয়ে দেখা আর কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কী করার ছিল।
শফিকা রোববার রাত কাটিয়েছেন পাশের একটি কটেজে। গতকাল সোমবার রাত কোথায় কাটাবেন, সে বিষয়ে তখনো তিনি নিশ্চিত নন।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে আমরা ক্ষয়ক্ষতির ধারণা আগেই পেয়েছিলাম। তিনি জানান, দ্বীপে ১ হাজার ৯০০টির মতো ঘরবাড়ি আছে। ৭০০টির মতো ঘরবাড়ি প্রায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব কাঁচা অথবা ঝুপড়ি—টিন, চাটাই অথবা ত্রিপল দিয়ে তৈরি। আরও ৩০০টির মতো ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোকানপাট, হোটেল, রিসোর্টও ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেক গাছপালা ভেঙেছে।
কয়েকটি রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টে গিয়ে দেখা যায়, পাকা দেয়াল টিকে আছে। তবে টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও মসজিদ। যেমন ক্রিড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি আধা পাকা ভবনের একটির টিনের চালা পুরোপুরি দুমড়েমুচড়ে গেছে। কবে নাগাদ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে, তা নিশ্চিত নন এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নয়ন চন্দ্র বর্মণ।
সেন্ট মার্টিনের বেশির ভাগ মানুষের জীবন চলে মাছ ধরে। পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ শীত মৌসুমে পর্যটন ঘিরে কাজ করেন, ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বেশ কিছুদিন ধরে মাছ ধরা বন্ধ। ২০ মে থেকে আবার প্রজনন মৌসুমের কারণে সাগরে ৬৫ দিনের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এখন পর্যটন মৌসুমও নয়। এমন সময়ে বেশির ভাগ মানুষের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে ঘূর্ণিঝড় মোখা।
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরদিন গতকাল সেন্ট মার্টিন পরিদর্শনে যান বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের জোনাল কমান্ডার (পূর্ব জোন) ক্যাপ্টেন সোহেল আজম, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম ও টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সিরাজুল মোস্তফাসহ দলের স্থানীয় নেতারাও গিয়েছিলেন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার (আজ) থেকে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে। যাঁদের ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের নগদ অর্থসহায়তা দেওয়া হবে। জেলা প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করা হয়েছে।
সেন্ট মার্টিনের সংকট এখন বহুমাত্রিক। সৌরবিদ্যুতের আলো পাওয়া যাচ্ছে না। জেনারেটর চালানোর মতো জ্বালানি তেল নেই। সুপেয় পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। অবশ্য মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক মাস ধরে দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় খাওয়ার পানির সংকট চলছিল। টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ত। এখন সেই লবণাক্ততা আরও বেড়েছে। কোনাপাড়ায় দেখা গেল, ভ্যানগাড়িতে কলসি, বোতলসহ নানা পাত্র নিয়ে পানির জন্য ছুটছেন মানুষ। একটি রিসোর্ট থেকে তাঁরা পানযোগ্য পানি সংগ্রহ করবেন।
দ্বীপ ঘুরে মানুষের দুর্দশা দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে এল। এটি ঘূর্ণিঝড় মোখার পর দ্বিতীয় রাত। দেখলাম, দুই দিন আগেও যাঁদের সাজানো সংসার ছিল, তাঁরা এখন রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে ব্যস্ত।