নিয়মিত হাত ধোয়া স্বাস্থ্যসচেতনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক। করোনাকালে নিয়ম মেনে হাত ধোয়া সবার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভ্যাসও পুরোনো রূপে ফিরতে শুরু করেছে। করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বে প্রায় ৭৬ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০ লাখের বেশি। মারা গেছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। বিশ্বব্যাপী এক বিলিয়নের মতো মানুষ নিয়মিত হাত ধোয়ার কারণে করোনা মহামারি থেকে বেঁচে গেছেন।
নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস মহামারির মতো এমন অনেক রোগ থেকেই সুরক্ষা দেয়। স্বাস্থ্যসচেতন নই বলে আমরা অনেকেই নিজেদের অজান্তে হাত না ধুয়ে খাবার খাই। পরিবারের বড়দের সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে হাত না ধুয়ে খাবার খাওয়া। কিন্তু হাত পরিষ্কার রাখা এবং হাত ধোয়া হলো কম খরচে টেকসই স্বাস্থ্য–ব্যবস্থাপনার একটি অংশ। বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষেরা এ অভ্যাসের চর্চা করছেন।
টেকসই স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ বিশ্বব্যাপী আহ্বান করেছে, হাত ধোয়াকে যেন অভ্যাসে পরিণত করা হয়। কিন্তু সারা বিশ্বে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ হাত ধোয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ উন্নত পানির সুবিধা পেলেও হাইজিন সুবিধা পাচ্ছে মাত্র ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ (এমআইসিএস-২০১৯, জেএমপি-২০২২), যা সরকারি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তৈরি সফলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
করোনার সময় দেখা মিলেছে স্বাস্থ্যসচেতনতার। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষও সুঅভ্যাস থেকে সরে আসছে। করোনা কমে গেছে ঠিক, কিন্তু সংক্রামক আরও বহু রোগ রয়েছে। তাই হাত ধোয়ার এই অভ্যাসে আবার জোর দিতে হবে। শিশু কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক যে–ই হোন না কেন, নিয়মিত হাত ধোয়া সুস্থ রাখবে একজন মানুষকে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব সম্প্রদায় হাত ধোয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৬ অর্জনে হাত ধোয়ার বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন হাত ধোয়ার চর্চা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোসহ বাসাবাড়িতে হাত ধোয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, হাত ধোয়ার মাধ্যমে জীবন রক্ষা হবে, চিকিৎসা বাবদ অর্থ সাশ্রয় হবে এবং সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচা যাবে। তাই সব ক্ষেত্রে হাত ধোয়ার ওপর জোর দিতে হবে।’
‘ইফেক্ট অব ওয়াশিং হ্যান্ডস উইদ সোপ অন ডায়রিয়া রিস্ক ইন দ্য কমিউনিটি: আ সিস্টেমেটিক রিভিউ’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, সাবান দিয়ে হাত ধুলে শিশুদের ডায়রিয়া থেকে সুরক্ষা দেয় ৩০ থেকে ৪৭ শতাংশ। আর শ্বাসজনিত রোগের ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেয় ২৩ শতাংশ। শিশুরা জানে, রোগ প্রতিরোধে হাত ধোয়া একটি কার্যকর উপায়। কিন্তু হাত ধোবে কোথায়? অনেক বিদ্যালয়ে পানির বেসিন থাকলেও সাবান থাকে না। অনেক সময় কোনোরকম সাবান থাকলেও পানির প্রবাহ থাকে না। শিশুরা কিংবা সাধারণ মানুষ সচেতন হলেও এসব উপযোগের অভাবে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে তারা হাত ধোয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দেশের ৯৯ শতাংশ বিদ্যালয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে যথেষ্ট পানি ও সাবানের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ৪৮ শতাংশ বিদ্যালয়ে। শিশুদের দিনের একটা বড় সময় স্কুলেই কাটাতে হয়। স্কুলে কোথায় হাত ধোবে—এ বিষয়ে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শাখাপ্রধান সৈয়দা তানজীনা ইমাম বলেন, ‘করোনাকালীন আমরা স্কুলে বেসিন বসিয়েছি। হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছি। শিশুরা কিন্তু দল বেঁধে আনন্দচিত্তে হাত ধোয়। এখনো মনে করিয়ে দিলেই ওরা খুশি মনে হাত ধোয়। আমার স্কুলে হাত ধোয়ার এমন ব্যবস্থা আছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, জেলা-উপজেলার সব স্কুলে এমন হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। শুধু বেসিন বসিয়ে রেখে দেওয়াই না, পানি ও সাবানের ব্যবস্থার দিকটিও নিশ্চিত করতে হবে।’
সংক্রামক রোগ শিশুদের মধ্যে দ্রুত ছড়ায়। তাই স্কুলগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ডা. মুশতাক হোসেন বড়দের হাত ধোয়ার বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাসার গ্যারেজে, অফিসের প্রবেশস্থানে, হাসপাতাল ও শপিং মলে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখলে তা জনগণের অসুস্থতা অনেকাংশে কমিয়ে দেবে।’
জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে হাত ধোয়ার অভ্যাস নিয়ে কাজ করছে ‘হ্যাপিট্যাপ’। হ্যাপিট্যাপের গ্লোবাল বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর রুমাত আশরাফ বলেন, ‘করোনার পর হাত ধোয়ার অভ্যাস নিয়ে কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এর কারণ খুঁজে বের করা এবং সমাধানের পথে হাঁটার জন্য আমরা নানা ধরনের ক্যাম্পেইন করছি। এই ক্যাম্পেইনেই স্কুলের এক শিশুর সরল প্রশ্ন ছিল, তারা তো হাত ধুতেই চায়, কিন্তু হাত ধোবে কোথায়? কারণ, অধিকাংশ স্কুলে হাত ধোয়ার জন্য সাবান-পানির কোনো ব্যবস্থা থাকে না। তেমনি অনেকের বাড়িতেও একই অবস্থা। একটি শিশুর মনের সরল প্রশ্ন বুঝিয়ে দিয়েছে, আসলে সমস্যাটা কোথায় এবং আমরা কীভাবে তা সমাধান করতে পারি।’
হাত ধোয়ার নিয়মিত অভ্যাস গড়ে উঠছে না কেন? রুমাত আশরাফ এ সমস্যা সমাধানের পথ উল্লেখ করে বলেন, ‘সাশ্রয়ী মূল্যে হাত ধোয়ার পণ্যসামগ্রী ও পরিষেবা নিশ্চিত করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ জন্য স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রসহ পাবলিক ও পারিবারিক টয়লেটে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। প্রত্যন্ত গ্রামেও যেন হাত ধোয়ার সামগ্রীর ব্যবস্থা থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে। যখন হাতের কাছেই হাত ধোয়ার সব সামগ্রী থাকবে, তখন হাত ধোয়ার অভ্যাসটাও নিয়মিত হবে।’