দলীয়করণে বিপর্যস্ত পুলিশ বাহিনী, পুনর্গঠন ও সংস্কার দাবি

পুলিশ

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভেঙে পড়েছে পুলিশের ‘চেইন অব কমান্ড’। টানা তিন দিন পুলিশের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গত শুক্রবার থেকে পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন। অনেক থানায় সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে পুলিশ সদস্যদের অনেকেই এখনো নিরাপদবোধ করছেন না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টানা তিন মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকায় পুলিশের মধ্যে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ হয়েছে। বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে অতি উৎসাহী একটি অংশ দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে পুলিশকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ ও বেপরোয়াভাবে গুলি করে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রেও অতি উৎসাহী কর্মকর্তাদের ভূমিকা রয়েছে। যদিও শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর পাওয়া মাত্র ওই সব কর্মকর্তা দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান।

আরও পড়ুন

পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলামও দায়িত্ব গ্রহণের পর বলেন, ‘আমাদের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের অনেক সহকর্মী আহত, নিহত ও নিগৃহীত হয়েছেন।’

এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। তাঁদের দাবি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মানতে গিয়েই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়েছেন।

এ অবস্থায় বাহিনী পুনর্গঠন ও সংস্কারে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন জরুরি কাজ হচ্ছে, পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাঁদের কর্মস্থলে ফেরানো। একই সঙ্গে বাহিনীর শীর্ষ পদগুলোতে সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের বসাতে হবে। এ ছাড়া দলীয় পরিচয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ও অপেশাদার কর্মকাণ্ডে যুক্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পদোন্নতি ও পদায়নের স্বচ্ছ নীতিমালা তৈরি ও কার্যকর এবং নিচের সারির সদস্যদের ন্যায্য সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন পেশাদার কর্মকর্তাদের অনেকে। তবে তাঁরা মনে করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পদোন্নতি ও পদায়নে নতুন অতি উৎসাহী গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সংস্কারের চিন্তা ও উদ্যোগ হোঁচট খাবে।

আরও পড়ুন

গত শুক্রবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম অনানুষ্ঠানিক বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, যত দ্রুত সম্ভব পুলিশ বাহিনী যেন কাজে নেমে যায় এবং সবাই যেন পুলিশকে সাহায্য করেন—এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

তবে দীর্ঘদিনের দলীয়করণের ফলে যে ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাকে পুনর্গঠন ও সংস্কারের কাজটি বেশ কঠিন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অতি উৎসাহী ভূমিকায় ছিলেন এমন কর্মকর্তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়ে গেছেন। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যাঁরা চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাঁরা এখন নতুন করে পদায়ন ও পদোন্নতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে কিছু কর্মকর্তার হাতে পুলিশ বাহিনী জিম্মি ছিল। দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে তাঁরা প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক হন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁরা পুরো বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের কারণেই এখন সবাই বিপদে পড়েছেন।

আরও পড়ুন

দলীয়করণ বন্ধে স্থায়ী সংস্কার দাবি

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও আতঙ্কে পুলিশি কার্যক্রম কার্যত থেমে যায়। থানাগুলো পাহারা দিচ্ছে সেনাবাহিনী, আনসার ও শিক্ষার্থীরা। পুলিশ সদর দপ্তর বাহিনীর সব সদস্যকে ৮ আগস্ট সন্ধ্যার মধ্যে কাজে যোগ দিতে বলে। এরপর গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৩৮টি থানায় কার্যক্রম শুরু হয়। এর মধ্যে অধিকাংশ থানায় সীমিত পরিসরে কাজ চলছে। অনেক সদস্য এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাহিনীটির কর্মপরিধিতে আমূল সংস্কার ও জবাবদিহির সংস্কৃতি নিশ্চিত করতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি উঠেছে। বাহিনীর সদস্যদের পোশাক পরিবর্তনের দাবিও করছেন কেউ কেউ। এর সঙ্গে পুলিশের সব পর্যায়ে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্য নিরসনের দাবি করেছেন পুলিশের বিক্ষুব্ধ সদস্যরা।

পুলিশের কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যায়ের সদস্যদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অবকাঠামোগুলো সংস্কার করে কার্যক্রম শুরু করলেও মৌলিক সংস্কার না হলে ভবিষ্যতেও বাহিনীতে দলীয়করণ বন্ধ হবে না। এ জন্য তাঁরা সরকারের কাছে বেশ কিছু দাবিও জানিয়েছেন। দাবিগুলোর মধ্যে আছে—কোনো দলীয় সরকার যেন তাঁদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে পুলিশকে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশনের অধীন বাহিনীটিকে পরিচালনা করা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোনো বেআইনি বা বিপজ্জনক মৌখিক আদেশ যাতে পালন করতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করা।

আরও পড়ুন

মনোবল ফেরানোর চেষ্টা

সদস্যদের মনোবল ও আস্থা ফেরাতে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। সদস্যদের দাবি পূরণে বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে দফায় দফায় আলাপ-আলোচনা চলছে। আহত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছেন নবনিযুক্ত আইজিপি। পাশাপাশি তাঁদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।

এর বাইরে মহানগর পুলিশের কমিশনার ও জেলার পুলিশ সুপারদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের থানা এলাকায় জ্যেষ্ঠ নাগরিক, পেশাজীবী, ছাত্র প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এই কমিটির আকার নির্ধারণ করবেন স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এ ছাড়া পুলিশকে কাজে যোগদানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্য সর্বসাধারণের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

আরও পড়ুন

বৈষম্য নিরসনের দাবি

হাসিনা সরকার পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণে নিহত পুলিশ সদস্যদের বেশির ভাগই কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ফলে এই পর্যায়ের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা বাহিনীতে বেশ কিছু বৈষম্যের কথা তুলে ধরে তা সমাধানেরও দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের দাবি পূরণে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন আইজিপি ময়নুল ইসলাম।

নন-ক্যাডার এই পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবিগুলোর মধ্যে আছে দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করানো যাবে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদোন্নতির মতো পন্থা অবলম্বন করতে হবে। বার্ষিক নৈমিত্তিক ছুটি ২০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিন করতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতো অধস্তন কর্মকর্তাদের ‘সোর্স মানি’ দিতে হবে। পুলিশের প্রতিটি ইউনিটে মাসের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে টিএ-ডিএ বিল পরিশোধ করতে হবে। নতুন বেতন স্কেল প্রণয়ন করতে হবে ও ঝুঁকিভাতা বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুন

রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে কেবল কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৯২৫ জন। উপপরিদর্শক (এসআই) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার। অর্থাৎ মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অর্ধেকের বেশিই নিয়োগ পেয়েছেন শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে।

অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের বড় অংশ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া স্বজনপ্রীতি ও অর্থ লেনদেনের মাধ্যমেও অনেকের নিয়োগ হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নিয়োগের আগে পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় খতিয়ে দেখা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের আন্দোলন দমন এবং ‘রাতের ভোট’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে পুলিশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ২০২৪ সালের ভোটের আগেও আন্দোলন দমন ও ‘গায়েবি মামলা’ দিয়ে বিরোধী দলকে হয়রানির ক্ষেত্রেও পুলিশ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনে অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগের ক্ষেত্রেও গত ১৫ বছরে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্যদের একটি অংশকে অতি উৎসাহী ভূমিকায় দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

পুলিশ বাহিনীর এমন ভঙ্গুর পরিস্থিতি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে পুলিশ বাহিনীকে দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো পেশাদারত্ব ছিল না। জাতীয় সংসদের মতো এলাকায় পুলিশ দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মারধর করা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি দমনের শুরুতেই গুলি চালানো হয়েছে। এভাবে মানুষের ওপর যে অন্যায়-অত্যাচার হয়েছে, তার একটি প্রতিক্রিয়া সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি।’

দলীয়করণের মাধ্যমে পুলিশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে উল্লেখ করে নূর মোহাম্মদ বলেন, এখন পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। যাঁদের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হলো, তাঁদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের সাহস দিতে হবে। সব পর্যায় থেকে সহযোগিতা করতে হবে।

আরও পড়ুন