সোহরাওয়ার্দীতে ধর্ষণের শিকার প্রবীণ নারীকে নিয়েও পরিবার খুঁজে পায়নি পুলিশ
ঢাকায় কয়েকজন নারীর সঙ্গে এসেছিলেন। শুনেছিলেন, ঢাকায় ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় তাঁর বাড়ি। ঠিক কবে তিনি এসেছিলেন, সেটাও মনে নেই। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে গত রোববার উদ্ধার করা ধর্ষণের শিকার ৬৫ বছর বয়সী নারীর বিষয়ে এর চেয়ে বেশি তথ্য জোগাড় করতে পারেনি পুলিশ। মঙ্গলবার শাহবাগ থানার পুলিশ হাসপাতাল থেকে অনুমতি পেয়ে প্রবীণ ওই নারীকে নিয়ে ফতুল্লা ঘুরেও পরিবারের খোঁজ পায়নি। পরিবারের কারও খোঁজ না পেয়ে মঙ্গলবার পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর ৯(৩) ধারায় দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে।
প্রবীণ ওই নারী এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসাধীন। বুধবার ওসিসিতে গিয়ে জানা যায়, বেশির ভাগ সময় তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকেন। ওসিসিতে ভুক্তভোগীর সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলার অনুমতি পাওয়া যায় না। তবে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, শয্যায় তিনি ঘুমাচ্ছেন। শরীর এতটাই জীর্ণ-শীর্ণ যে মনে হচ্ছিল ‘বিছানার সঙ্গে লেগে আছেন’। চিকিৎসকদের ভাষায়, তাঁর গায়ের চামড়া থেকে অনুমান করা যায় বয়স তাঁর আরও বেশি, ৭০-৭৫ বছরও হতে পারে।
পুলিশ ও ওসিসি থেকে জানা গেছে, গত রোববার বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে প্রবীণ নারীকে ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। ওই নারীকে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে লোকজন জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯) কল দেন। এরপর শাহবাগ থানা-পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নারীকে উদ্ধার করে। ভুক্তভোগী নারী পুলিশ, ওসিসির চিকিৎসক ও আইনজীবীদের জানিয়েছেন, আগের দিন শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাতে ৫-৬ জন দুর্বৃত্ত তাঁকে ধর্ষণ করেছে। তিনি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ছেলের সঙ্গে থাকতেন। ছেলের নামও বলেছেন। তবে তিনি চান না ছেলে ধর্ষণের ঘটনা জানুক। একবার তিনি বলেছেন, ছেলে ও পুত্রবধূ তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। আবার এমনও বলেছেন, ত্রাণ পাওয়ার আশায় তিনি নিজেই কয়েকজন নারীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন।
এর আগে ২০২১ সালে যশোরে শতবর্ষী এক প্রবীণ নারীকে ঘরে ঢুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় রুবায়েত (২০) নামের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই ঘটনার কথা তুলে ধরে ওসিসির সমন্বয়কারী চিকিৎসক সাবিনা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাজে ছোট শিশু থেকে প্রবীণ নারী পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। মাদকাসক্ত, নীতিনৈতিকতাহীন ব্যক্তিরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। এই প্রবীণ নারীকে মারধরও করা হয়েছে। আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।’ ভুক্তভোগী নারীর শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা স্থিতিশীল হলেও এখনো তিনি বেশ অসুস্থ বলে জানান ওসিসির সমন্বয়কারী।
প্রবীণ নারী ধর্ষণের ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আসাদুজ্জামান বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ওই প্রবীণ নারীকে নিয়ে তাঁরা ফতুল্লায় গিয়েছিলেন। ওই নারী যে জায়গার কথা বলেছেন, সেই জায়গাসহ আশপাশের সব জায়গা খোঁজা হয়েছে। কেউ তাঁকে চেনেন না। ওই নারীর ছেলেকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ বাদী হয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছে। ওই নারীর পরিবারের বিষয়ে কেউ তথ্য পেলে পুলিশকে জানাতেও অনুরোধ করেন তিনি।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর ৯(৩) ধারা অনুসারে, একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা আহত হলে ওই ব্যক্তিদের প্রত্যেকে মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এর বাইরে কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেমের মতে, সাংস্কৃতিক চেতনার অভাব, ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও দুর্নীতিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। প্রবীণ নারী ধর্ষণের ঘটনা সেসবেরই প্রতিফলন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে মনোযোগ আকর্ষণ করা যাচ্ছে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো ভঙ্গুর। এ পরিস্থিতিতে নারীরা আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সারা দেশে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।