বন্দিশালায় ভয়াবহ নির্যাতন, হত্যার পর লাশ গুমের নানা কৌশল

গুমপ্রতীকী ছবি

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের কীভাবে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে, তার কিছু নমুনা গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে উঠে এসেছে, গুমের পর বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে নির্যাতন চালাতেন। হত্যার পর কীভাবে লাশ গুম করা হতো, তার বর্ণনাও পাওয়া গেছে।

‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক এই প্রতিবেদন গত শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে তদন্ত কমিশন। গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত এই কমিশন ১ হাজার ৬৭৬টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে তারা। কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে উঠে এসেছে নির্যাতন ও হত্যার ভয়াবহ বর্ণনা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের পর নির্যাতনের যেসব ঘটনার বিষয়ে তদন্ত কমিশন জানতে পেরেছে, তা নৃশংস এবং যে পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা ভয়াবহ। তবে সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশের মতো অন্য বাহিনীর নির্যাতনের ঘটনায় বেশ পার্থক্য দেখা গেছে।

ঠোঁট সেলাই, যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক

গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের মতো বেসামরিক বাহিনীগুলোর বন্দিশালায় নির্যাতন চালানো হতো নিয়মিত ভিত্তিতে। গুম কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে, নির্যাতনের ক্ষেত্রে এমন কিছু যন্ত্র–সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো, যেগুলো শুধু নির্যাতন চালানোর জন্য তৈরি। একই জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা নিয়মিত নির্যাতন চালাতেন।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের কথা থেকে জানা গেছে, বন্দিশালার কাছাকাছি অবস্থানে বসে অফিস করতেন কর্মকর্তারা। আশপাশে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা যন্ত্রণায় কাতরালেও শান্তভাবে কাজ করে যেতেন তাঁরা। এতে বোঝা যায়, এসব বিষয় এই কর্মকর্তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

তবে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রিত বাহিনীগুলো যেমন র‍্যাব ও ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালায় নির্যাতনের জন্য ছিল বিশেষ বন্দোবস্ত। এসব গোপন বন্দিশালা এমনভাবে তৈরি করা হতো, যেখানকার শব্দ বাইরে থেকে শোনা যেত না। নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্র–সরঞ্জাম থাকত। শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালানোর জন্য বিশেষভাবে যন্ত্র–সরঞ্জাম তৈরি করা হতো।

কমিশন জানিয়েছে, তদন্তের স্বার্থে এসব গোপন বন্দিশালা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বন্দিশালা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হবে। নির্যাতনের ধরন ও মাত্রা নিয়ে ধারণা দিতে দুটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী এ প্রতিবেদনে।  

প্রথম ঘটনাটি ২০১০ সালের। রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে এক তরুণকে তুলে নিয়ে যায় র‍্যাব। ওই তরুণ জানান, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কোনো চেতনানাশক ব্যবহার না করেই তাঁর দুই ঠোঁট সেলাই করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি ২০১৮ সালের। এবার মাঝবয়সী এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর যৌনাঙ্গ ও কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। এই ব্যক্তির ওপরে ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনাটিও ঘটে র‍্যাবের এক বন্দিশালায়।

কমিশন বলছে, এই দুটি ঘটনায় নির্যাতনের মাত্রা ও ব্যাপ্তি কতটা ব্যাপক ছিল, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে এ ধরনের নির্যাতনের ‘সংস্কৃতি’ তৈরি এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

গুলি করে হত্যা, লাশ ফেলা হতো নদীতে

গুমের শিকার ব্যক্তিদের বেশির ভাগ সময় হত্যা, নয়তো ফৌজদারি অপরাধে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করা হতো। অল্প কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কেউ কেউ ছাড়া পান।

গুমের পর যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন, তাঁদের কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। গুমের শিকার কিছু কিছু ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। র‍্যাবে কাজ করেছেন, সামরিক বাহিনীর এমন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে লাশ ফেলে দেওয়া হতো নদীতে। যেসব নদীতে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হতো, তার মধ্যে রয়েছে ঢাকার অদূরের বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। নদীতে লাশ ফেলার জন্য ঢাকার পোস্তগোলা ও কাঞ্চন ব্রিজ ব্যবহার করা হতো। পোস্তগোলা সেতু এলাকায় একটি নৌকা রাখা ছিল। হত্যার পর লাশ গুমের কাজে এই নৌকা ব্যবহার করা হতো।

হত্যায় প্রায়ই সরাসরি অংশ নিতেন কর্মকর্তারা। র‍্যাবের একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন, এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছে কমিশন। তিনি জানান, র‍্যাবে যোগদানের পর ‘ওরিয়েন্টেশনের’ কথা বলে সংস্থাটির তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধানের নেতৃত্বে তাঁকে কোনো একটি সেতুতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাঁর সামনেই দুজন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আরও পড়ুন

র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন, এমন একজন সেনাসদস্য কমিশনকে জানান, গুমের শিকার এক ব্যক্তি সেতু থেকে নদীতে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। নদীতে লাফ দেওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে তুলে আনেন তিনি। উদ্ধারের পরে সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়।

গুমের পর হত্যা ও লাশ নিশ্চিহ্ন করার আরও বিকল্প পদ্ধতির বিষয়ে জানতে পেরেছে কমিশন। একজন সেনাসদস্য জানান, একবার তাঁকে একটি লাশ নিয়ে ঢাকার একটি রেললাইনে যেতে বলা হয়। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় লাশটি রেললাইনে রাখতে, যাতে ট্রেন গেলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

ওই সেনাসদস্য জানান, গাড়িতে করে লাশ এনে রেললাইনের ওপর রাখার পর তিনি ও একজন কর্মকর্তা গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন কখন ট্রেন আসবে। ট্রেন গেলে তাঁরাও চলে যান।

আরও পড়ুন

গুমের শিকার এক ব্যক্তিকে চলন্ত গাড়ির সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার একটি ঘটনার বিষয় জানতে পেরেছে কমিশন। জীবিত ফিরে আসা একজনের ভাষ্যমতে, তাঁকে প্রথমে একটি মহাসড়কে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর একজন পুলিশ কর্মকর্তা চলন্ত একটি গাড়ির সামনে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ফেলে দেন। কিন্তু গাড়িটি পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা দ্বিতীয়বার গাড়ির সামনে তাঁকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। এ কারণে গুমের শিকার ওই ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান।

এসব ঘটনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের হত্যার ক্ষেত্রে একেক বাহিনী একেক ধরনের কৌশল ব্যবহার করত। তবে একটা ব্যাপারে সবার ক্ষেত্রে মিল ছিল, সেটা হলো হত্যা করা। কিছু ক্ষেত্রে লাশ এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করা হতো, যাতে উদ্ধার বা শনাক্ত করা না যায়।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম, হত্যা ও লাশ নিশ্চিহ্ন করার পদ্ধতি এবং এতে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি দেখে বোঝা যায়, কতটা সমন্বিতভাবে এ কাজ করা হতো। এসব ঘটনার মাত্রা ও ব্যাপকতা পুরোপুরি উদ্‌ঘাটন করতে হলে বড় পরিসরে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন