‘নাটক কম করো পিও!’—এমন সাড়া ফেলেছিল আরও যত কার্টুন
কণ্ঠস্বর ব্যবহার না করেও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার এক অনন্য উপায় হচ্ছে রাজনৈতিক কার্টুন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে আঁকা কার্টুনগুলোও এবার সে ভূমিকা রেখেছে। জুলাই–আগস্টে মাত্র তিন সপ্তাহে আঁকা হয়েছে শত শত রম্য, উপহাস, বিদ্রূপ ও যন্ত্রণার কথা বলা রাজনৈতিক কার্টুন। সব কার্টুন মানোত্তীর্ণ, তা নয়। সবগুলোর নির্দিষ্ট নামকরণও হয়নি। সময় ও ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে বিদ্রূপাত্মক বিভিন্ন দৃশ্য। স্লোগানের মতো রাজনৈতিক কার্টুনও উৎসাহ দিয়েছে এ আন্দোলনে। অথচ এক দশকের বেশি সময় ধরে মূলধারার গণমাধ্যমে রাজনৈতিক কার্টুন কম দেখা গেছে।
রাজনৈতিক কার্টুন
বাংলাদেশের প্রথিতযশা কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব গত ৩ আগস্ট একটি কার্টুন প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, লালের ওপর (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনের রং) আঁকা হয়েছে একটি বালুঘড়ি। ঘড়ির ওপরে আর তখন নামমাত্র বালু আছে নিচে নামতে। লেখা আছে ‘কাউন্ট ডাউন’। ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার আন্দোলন সফল হওয়ার মাত্র এক দিন আগে এ কার্টুনটি ইঙ্গিত দিয়েছিল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। পাঁচ দিন পর ৮ আগস্ট তিনি আবার আঁকলেন একই রকম আরেকটি ছবি। পার্থক্য হচ্ছে বালুর অবস্থান। এবার সবটুকু একপাশে। আহসান হাবীব ক্যাপশন দেন, ‘ডান---নিউ স্টার্ট’। তাঁর সম্পাদিত রম্য সাময়িকী উন্মাদ–এর আগস্ট সংখ্যার নাম দেওয়া হয় ‘নতুন সরকার নতুন উন্মাদ’।
মেহেদী হক কার্টুন এঁকেছেন ধারাবাহিকভাবে। শেখ হাসিনা, সালমান এফ রহমান, সাকিব আল হাসান—কেউই বাদ যাননি তাঁর হাত থেকে। এর মধ্যে গত ৩০ জুলাই নিউ এজ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি কার্টুন খুব জনপ্রিয় হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষ দিকে ছয় সমন্বয়ককে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা ও খাওয়ার টেবিলে বসিয়ে ভিডিও করার দৃশ্য ভাইরাল হওয়ার পর তিনি আঁকেন এ কার্টুন। কার্টুনটি সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের নুডলসের বাটি হাতে নিয়ে বসে থাকার দৃশ্য। টেলিভিশনের ভেতর থেকে তারেক রহমানের আধাআধি বের হয়ে আসা কার্টুনটিও সাড়া ফেলে। একই রকম জনপ্রিয় হয় ছাত্রদের সঙ্গে শেখ হাসিনার আলোচনার প্রস্তাবের নামে উপহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া কার্টুনটি।
পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা ও প্রকাশের ধরন। যেমন তরুণ কার্টুনশিল্পী মাহাতাব রশিদ ১৫ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার কার্টুন এঁকেছেন। যেখানে বানরের মতো মানুষ বসে আছে হেলমেট, রামদা, লাঠি নিয়ে। চারপাশে রক্তের দাগ। মাথার ওপর আছে শাড়ি পরা এক নারীর আশীবার্দের হাত। এই তরুণ আর্টিস্টই ৫ আগস্ট আঁকলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পূর্ণ অবয়ব। যেখানে লেখা আছে—এক দফা এক দাবির কথা। এ কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, তাঁকে দড়ি বেঁধে টেনে নামাচ্ছেন শিক্ষার্থী ও জনগণ। এই দৃশ্য মনে করিয়ে দেবে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশ’–এর কথা। মাহাতাব রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবারের আন্দোলনে আমার আঁকা শেখ হাসিনার সম্পূর্ণ অবয়বের প্রথম কোনো কার্টুন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁর পদত্যাগের পর। এর আগে আমার আঁকা তাঁর কোনো পরিপূর্ণ আদলের কার্টুন পত্রিকায় প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।’
এবারের আন্দালেন নাজমুস সাদাতের কার্টুনে নিজের দিকে বন্দুকের নল টেনে নেওয়া হাত, আসিফ মাহবুবের আঁকা রক্তাক্ত মুঠোফোন, রিশাম শাহাব তীর্থর আঁকা গণতন্ত্রকে নিরাপত্তা বাহিনী আর ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতন অথবা পুলিশের বুটের তলা আটকে রাখা শিক্ষার্থীর দলের কার্টুনগুলো আন্দোলনের সময় ঘটনার বার্তা দিয়ে পরিস্থিতি স্পষ্ট করেছে। মানিক রতনের আঁকা এক কার্টুনে পাওয়া গেল নারীর শক্তিশালী এক হাতের ভেতর পিষ্ট হচ্ছে ছাত্র। যেখানে লেখা আছে—এই কোমলমতি...।
আরাফাত করিমের আঁকা কার্টুনটি গভীর এক অর্থ বহন করেছে। এই কার্টুন আন্দোলন–পরবর্তী সময়ের, যেখানে দেখা যাচ্ছে উদোম শরীরের একজনের হাতে ভাঁজ করা টি–শার্টে লেখা ছাত্রলীগ। এবার সে টি–শার্টটি বদলে এগিয়ে যাচ্ছে আলনার দিকে, যেখানে আছে জামায়াত, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন দলের নাম লেখা পোশাক। গণ-অভ্যুত্থানের পরপর দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি। কার্টুনিস্ট রাকিব এঁকেছিলেন শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে কারও আর্তনাদ করে ‘আমারেও নিয়া যাও’ বলার দৃশ্যটি। এবারের আন্দালন ঘিরে রাজনৈতিক কার্টুন শুধু শেখ হাসিনা, ছাত্র-জনতা, পুলিশের গুলির মতো প্রসঙ্গেই থেমে থাকেনি; গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা থেকে আঁকা হয়েছে ‘ঐক্য অথবা মৃত্যু’র মতো কার্টুনও। রায়িদ হোসেনের আঁকা এই কার্টুনে দেখা যায়, একটি বাঘের শরীরের অবয়ব ঠিকই আছে, কিন্তু প্রতিটি প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন। শিল্পী ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, ‘বাঘের বিভিন্ন অংশ আমাদের লোকেদের (দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের) প্রতিনিধিত্ব করে। তিনটি জল লিলি মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকে প্রতিনিধিত্ব করে।’
ঐক্য অথবা মৃত্যু কার্টুনটি মনে করিয়ে দেয় প্রথম এডিটোরিয়াল কার্টুনটির কথা। ১৭৫৪ সালে প্রকাশিত সে কার্টুনে দেখা যায়, একটি সরীসৃপের শরীর কয়েক খণ্ড করে কাটা। একেকটি খণ্ডে বিভিন্ন রাজ্যের নাম উল্লেখ করা। এই কার্টুনের ক্যাপশন ছিল, জয়েন অর ডাই। এডিটোরিয়াল কার্টুনের ইতিহাস নিয়ে লেখা এক ইংরেজি প্রবন্ধে পাওয়া যাবে সেই কার্টুনের ইতিহাস। তবে এবারের আন্দোলনে উঠে আসা সব কার্টুনই যে খুব ভালো হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিন্তু এই যে বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ, সেটাই ছিল এক শক্তি।
‘সব কার্টুনই মানোত্তীর্ণ নয়’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে পরে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সময়েও দেশের সংবাদপত্রে কার্টুন ছাপা হয়েছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসক প্রয়াত জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। এর পরের প্রায় দুই দশক আলোচিত নানা ইস্যু বা ব্যক্তিকে ঘিরে আঁকা কার্টুন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল সংবাদপত্রে। তখন প্রথম পাতায়ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিকে নিয়ে নিয়মিত কার্টুন প্রকাশ করেছে সংবাপত্রগুলো। জনপ্রিয় হয়েছেন অনেক শিল্পী।
কিন্তু গত এক দশক ধরে মূলধারার রাজনৈতিক কার্টুন প্রকাশের সুযোগ ছিল সংকীর্ণ। এবারের আন্দোলনে দেখা গেছে কার্টুনিস্ট, শিল্পী, শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমে প্রকাশের অপেক্ষায় না থেকে যাঁর যেভাবে সুযোগ ছিল সেভাবেই প্রকাশ করেছেন। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে শহরের দেয়ালে দেয়ালে উঠে এসেছে কার্টুন। তবে সবই যে মানোত্তীর্ণ, তা নয়। কারো কারো হয়তো এটাই ছিল প্রথম প্রতিবাদের ভাষা। কার্টুনিস্ট মেহেদী হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব কার্টুন যে মানোত্তীর্ণ, তা বলা যাবে না। কিন্তু এবার অনেক নতুন শিল্পী চমৎকার কাজ করেছেন। যাঁদের পড়াশোনা চারুকলায় নয়, এমনকি কার্টুন আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নেই, তাঁদের মধ্যে শাদাত মাহবুব, নাতাশা জাহান অনেক ভালো ভালো কাজ করেছেন।’
আমাদের কার্টুনের ইতিহাস
বিলেতের ‘পাঞ্চ পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪১ সালে। সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই পত্রিকা ভারতবাসীকে অপমান করে কয়েকটি ব্যঙ্গচিত্র তৈরি করেছিল। এর মাত্র দুই দশকের মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছিল বাংলার প্রথম ব্যঙ্গচিত্রের বই। ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় হরবোলা ভাঁড় এবং বসন্তক ব্যঙ্গ পত্রিকা। ব্যঙ্গের তীব্র কশাঘাতে ব্রিটিশ শাসপ্রণালিকে বিদ্ধ করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে এ পত্রিকা। একে একে প্রকাশিত হয় হুতোম, বঙ্গীয় ভাঁড়, সচিত্র ব্যঙ্গ রহস্য ইত্যাদি। ফলে বাঙালি যে একেবারে বেরসিক অথবা ব্যঙ্গ বোঝে না, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কার্টুনের এই ইতিহাস পাওয়া যাবে ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাংলা পত্রিকার কার্টুন চর্চা (১৮৭২-১৯৪০)’ নামের বইয়ে।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে রম্যরচনা আর চিত্রকলার কার্টুন একই অর্থ বহন করে থাকে। বাঙালি রম্যরসপ্রিয় না হলে এত বিধিনিষেধের পরও আঁকিয়েদের প্রবল উৎসাহ থাকত না কার্টুন নিয়ে। এত দিন পরও মানুষ কার্টুনের প্রসঙ্গ এলেই বলত না শিশির ভট্টাচার্য্যের কথা। একসময় শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যের আঁকা রাজনৈতিক কার্টুনগুলো গণমাধ্যমের প্রথম পৃষ্ঠায় উপস্থিত হয়ে তির্যক ব্যঙ্গের মধ্য দিয়ে বলে দিত অনেক কিছু। এই কার্টুনগুলো হচ্ছে এডিটোরিয়াল ব্যঙ্গচিত্র।
সম্প্রতি রাজধানীর দৃক গ্যালারিতে হয়ে গেল ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’ শিরোনামে এক প্রদর্শনী। সেখানে মেহেদী হকের আঁকা শেখ হাসিনার দৌড়ে পালানোর একটি দৃশ্য এঁকে ই-আরকি লিখেছে, ‘দৃকে স্বৈরাচার পতনের কার্টুন এক্সিবিশনে আসতে পারবেন স্বৈরাচাররাও।’ আর র্যাটস আসিফ নামের একজন শিল্পীর আঁকা ‘নাটক কম করো পিও!’ কার্টুনটি যে কতটা জনপ্রিয় হয়েছে, তা একবার অন্তর্জালে ঢুঁ দিয়ে খুঁজলেই বোঝা যাবে।