আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি ‘মুজিব বর্ষ ১০০’ পঞ্জিকার এখন অস্তিত্বই নেই
‘মুজিব বর্ষ ১০০’ নামে একটি বিশেষ পঞ্জিকা যৌথভাবে তৈরি করেছিল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় তহবিল। এতে ব্যয় করা হয়েছিল প্রায় তিন লাখ টাকা। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বানানো এই পঞ্জিকার প্রথম মাসের নাম ছিল ‘স্বাধীনতা’। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন (১৭ মার্চ) ছিল এই মাসের প্রথম দিন। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মতো এটিরও গণনা করার কথা ছিল ৩৬৫ দিন ধরে। ২০২০ সালের ১৬ মার্চ পঞ্জিকাটির উদ্বোধন করেছিলেন তখনকার সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে পঞ্জিকাটি শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।
এই পঞ্জিকায় ১২টি মাস আছে। তবে কোনো অধিবর্ষ (ইংরেজি লিপইয়ার) নেই। ১২ মাসের নাম দেওয়া হয়েছিল—স্বাধীনতা, শপথ, বেতারযুদ্ধ, যুদ্ধ, শোক, কৌশলযুদ্ধ, আকাশযুদ্ধ, জেলহত্যা, বিজয়, ফিরে আসা, নবযাত্রা ও ভাষা। ২০২০ সালের ১৬ মার্চ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন শ্রমসচিব কে এম আলী আজম পঞ্জিকাটির মোড়ক উন্মোচন করে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, পঞ্জিকায় বেশ কিছু সংস্কার প্রয়োজন। সব অংশীজনের মতামত নিয়ে ক্যালেন্ডারটি চূড়ান্ত করে এরপর সরকারি সব দপ্তরে রাখার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
পঞ্জিকায় মুজিব বর্ষ ছাড়াও বাংলা সন, গ্রেগরিয়ান সন ও হিজরি সনের মাস ও তারিখ উল্লেখ ছিল। প্রতি মাসের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর ইতিহাস পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হয়েছিল। যেমন একাত্তরের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়। ‘মুজিব বর্ষ ১০০’ পঞ্জিকায় দিনটি পড়েছিল শপথ মাসের ১ তারিখ। ইংরেজি পঞ্জিকার ২১ ফেব্রুয়ারি পড়েছিল ভাষা মাসের ৫ তারিখ, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পড়েছিল বিজয় মাসের ৩০ তারিখে। এ ছাড়া প্রতি মাসেই ঐতিহাসিক ছবি দিয়ে পঞ্জিকাটি সাজানো হয়েছিল।
সম্প্রতি রাজধানীর শ্রম ভবনে কেন্দ্রীয় তহবিলের অফিসে গিয়ে পঞ্জিকাটির কপি দেখতে চাইলে কেউ তা দেখাতে পারেননি। কেন্দ্রীয় তহবিলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২০ সালে মুজিব শতবর্ষ স্মরণে ‘মুজিব বর্ষ ১০০’ পঞ্জিকাটি বাংলা ও ইংরেজিতে তিন হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। তখনই সচিবালয়, দূতাবাসসহ বিভিন্ন জায়গায় এগুলো বিতরণ করা হয়। এরপর পঞ্জিকাটির সংশোধন বা পরিমার্জনের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ কারণে ওই এক বছরই পঞ্জিকাটির চেহারা দেখেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় তহবিলের দেওয়া তথ্য বলছে, পঞ্জিকাটি বানাতে খরচ হয়েছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
মুজিব বর্ষ উদ্যাপন ও পঞ্জিকার ব্যয়
কেন্দ্রীয় তহবিলের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ২৩২ (৩) ধারার বিধান অনুযায়ী শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘কেন্দ্রীয় তহবিল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তহবিল পরিচালনার জন্য একটি পরিচালনা বোর্ডও গঠন করা হয়েছে। শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কার্যাদেশের বিপরীতে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হারে অর্থ বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হচ্ছে। এর বাইরে সরকার, দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছা অনুদানসহ বিভিন্ন অনুদান এতে জমা হয়।
কেন্দ্রীয় তহবিলে প্রাপ্ত মোট অর্থের ৫০ ভাগ সুবিধাভোগী কল্যাণ হিসাব এবং বাকি ৫০ ভাগ আপত্কালীন হিসাবে জমা হয়। শ্রমিক ও শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, চিকিৎসা নিশ্চিত করা, শ্রমিকের মেধাবী সন্তানের লেখাপড়ায় আর্থিক সহায়তা দেওয়া, কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে অথবা স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এ তহবিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় তহবিলের কর্মকর্তারা বলেছেন, মন্ত্রণালয় ও তহবিল পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের অনুমোদনেই ‘মুজিব বর্ষ ১০০’ পঞ্জিকাটি বের করা হয়েছিল। শ্রমিকদের কল্যাণের টাকা নয়, অফিস ম্যানেজমেন্ট ফান্ড থেকে এর খরচ অনুমোদন করা হয়েছিল। তবে পঞ্জিকাটি কোনো কাজে লাগেনি। উদ্বোধনের পরপরই পঞ্জিকার প্রথম দিনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করেছেন বলেও উল্লেখ করেন তাঁরা। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে এ নিয়ে তাঁদের কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না।
কেন্দ্রীয় তহবিলের তৎকালীন মহাপরিচালক এ এম এম আনিসুল আউয়ালের নেতৃত্বে পঞ্জিকাটি তৈরি করেছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তহবিলের পাঁচ সদস্যের একটি দল। সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুজিব শতবর্ষে নতুন কিছু করার তাগিদে মন্ত্রণালয় এবং বোর্ডের অনুমোদনে পঞ্জিকাটি প্রকাশ করা হয়েছিল। মুজিব শতবর্ষ স্মরণে এই পঞ্জিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনকে পঞ্জিকার প্রথম দিন ধরা হয়েছিল। যেমন খ্রিষ্টাব্দ ৬০০ শতকের আগে রাজা শশাঙ্কের আমলে তৈরি করা হয়েছিল শশাঙ্কব্দ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়কে মুজিব বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে মুজিব বর্ষের সময়কাল বাড়ানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে ঘোষিত মুজিব বর্ষে কী ধরনের কাজ হয়েছে, কত টাকা অপচয় হয়েছে—তা বের করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
এ নিয়ে গত বছরের ২০ নভেম্বর সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, মুজিব বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ছয় অর্থবছরে (২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪) ১ হাজার ২৬১ কোটি ৫ লাখ টাকা খরচ করেছিল বলে তথ্য পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বৈঠকে সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও আওতাধীন দপ্তর/সংস্থা, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের খরচের এ হিসাব তুলে ধরা হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে খরচের বরাদ্দ থাকলেও বর্তমান সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে এ–সংক্রান্ত বাজেট বরাদ্দ বাতিল করেছে।
এক বছর পরই পঞ্জিকাটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই, এ বিষয়কে অর্থের অপচয় বলা যায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এ এম এম আনিসুল আউয়াল বলেন, সরকারের অনুমোদনেই কাজটি করা হয়েছিল। এখানে কোনো চুরি বা অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি। পঞ্জিকাটিতে মুজিব বর্ষ বা শেখ মুজিবুর রহমানকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি স্বাধীনতার ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। মাসের নামের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, ভাষা আন্দোলন, জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয়। তবে এটা ঠিক, পঞ্জিকাটি পরে আর কোনো কাজে লাগেনি বা লাগানো হয়নি।