গ্রামের পাশাপাশি এবার ঢাকায়ও লোডশেডিং, বিভিন্ন এলাকায় জ্বলছে না চুলা
গ্যাসের সংকট কাটেনি। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। বকেয়া বিল জটিলতায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। কয়লা থেকে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। তবুও বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। এতে দুই দিন ধরে দেশের বিভিন্ন গ্রামে লোডশেডিং বেড়েছে। রাজধানী ঢাকায়ও গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে লোডশেডিং।
ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গতকাল ডিপিডিসি গড়ে ১০০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট সরবরাহ কম পেয়েছে। এতে কোনো এলাকায় এক ঘণ্টা আর কোনো এলাকায় দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দিতে হয়েছে।
গ্যাসের সরবরাহ কমায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রান্নার চুলা জ্বালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গ্যাসের গ্রাহকেরা। শিল্পকারখানায় আগেই উৎপাদন কমে এসেছিল গ্যাসের অভাবে।
তবে ডিপিডিসির চেয়ে বেশি ঘাটতি পেয়েছে ডেসকো। গতকাল বেলা দুইটায় ডেসকোর চাহিদা ছিল ১ হাজার ৩২৫ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ হয়েছে এক হাজার মেগাওয়াট। এতে সব এলাকাতেই লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গুলশান এলাকায়ও ৬১ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে ডেসকো। বারিধারায় লোডশেডিং হয়েছে গতকাল ৫০ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবির সব বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত আছে। জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর ফলে চাহিদামতো উৎপাদন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন
বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি ও পিজিসিবি সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। গতকাল দিনের বেলায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল দুপুর ১২টায় ১৪ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। ওই সময়ে ১ হাজার ৭৯৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। বুধবার থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় গড়ে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করা হচ্ছে। যদিও গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা বিতরণ সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত লোডশেডিং আরও বেশি।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবির সব বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত আছে। জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর ফলে চাহিদামতো উৎপাদন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ এক ঘণ্টা থাকলে এক ঘণ্টা বন্ধ থাকে।বিদ্যুৎ গ্রাহক মো. সোহেল
গ্রামে ভোগান্তি আরও বেশি
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি এলাকার বিদ্যুৎ গ্রাহক মো. সোহেল গতকাল দুপুরে বলেন, বিদ্যুৎ এক ঘণ্টা থাকলে এক ঘণ্টা বন্ধ থাকে। বরগুনা সদর উপজেলার গাজারবিঘা গ্রামের গ্রাহক নুরুল হক জানালেন, তাঁদের এলাকায় দিন-রাত মিলিয়ে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।
বগুড়া বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় ৮৩টি শিল্প ইউনিট চালু আছে। বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয় এখানে। বগুড়া বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আজিজার রহমান মিলটন বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ২০–৩০ শতাংশ কমেছে। দিনে-রাতে গড়ে ৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।
৯০ শতাংশ বাসায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ। ইপিজেডে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ আছে।কুমিল্লায় গ্যাস সরবরাহকারী বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপক মীর ফজলে রাব্বি
নেসকো বগুড়া সূত্র বলছে, চাহিদার তুলনায় গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সরবরাহ ঘাটতি। গড়ে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ মহাব্যবস্থাপক মোনোয়ারুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সময় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের ছয় জেলায় ২৪২ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয় বলে জানিয়েছেন পিজিসিবি ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুদুল হক। সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি এবং বৃষ্টিপাতের ফলে ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কমলেও হঠাৎ করে তিন দিন ধরে লোডশেডিং বেড়েছে।
পিডিবি সিলেটের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দিনে ৬ ঘণ্টার মতো লোডশেডিংয়ে কাটাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। গতকাল সরবরাহ-ঘাটতি ছিল ৫৪ মেগাওয়াট।
নেসকো বগুড়া সূত্র বলছে, চাহিদার তুলনায় গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সরবরাহ ঘাটতি। গড়ে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
গ্যাস–সংকটে শিল্প ও বাসা
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৫ কোটি ঘনফুট। এতে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২২৫ কোটি ঘনফুটে।
এলএনজি সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে সামিটের টার্মিনাল ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এটি ১৫ জুলাই আবার চালু হতে পারে। আর গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামে গ্যাসের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এলএনজি সরবরাহ কমে গেছে।
গ্যাসের সরবরাহ কমায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রান্নার চুলা জ্বালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গ্যাসের গ্রাহকেরা। শিল্পকারখানায় আগেই উৎপাদন কমে এসেছিল গ্যাসের অভাবে। কুমিল্লায় গ্যাস সরবরাহকারী বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপক মীর ফজলে রাব্বি বলেন, ৯০ শতাংশ বাসায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ। ইপিজেডে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ আছে।
গতকাল সন্ধ্যায় জিটিসিএলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মেরামতকাজের গতি ভালো। রাতের মধ্যেই গ্যাস সরবরাহের পরীক্ষা শুরুর চিন্তা। সব ঠিকঠাক এগোলে শুক্রবার (আজ) সকাল ছয়টার দিকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হতে পারে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা]