শিশুর বয়স নির্ধারণের এখতিয়ার তদন্ত কর্মকর্তার নেই, বিচারকের জন্য ৫ দফা নির্দেশনা

হাইকোর্ট ভবনফাইল ছবি

আইনের সংস্পর্শে আসা বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত কাউকে শিশু হিসেবে নির্ধারণ করার এখতিয়ার কোনো তদন্ত কর্মকর্তার নেই। তবে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত কাউকে শিশু হিসেবে আপাত মনে হলে তদন্ত কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠান তার বয়স নির্ধারণে শিশু আদালতে হাজির করবে। ২০১৩ সালের শিশু আইনের ২১ ধারার বিধান অনুসরণ করে বয়স নির্ধারণ করবেন শিশু আদালত।

‘মাওলানা আবদুস সাত্তার বনাম রাষ্ট্র এবং অন্য একজন’ শিরোনামের ফৌজদারি এক আপিল মঞ্জুর করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে এমন নির্দেশনাসহ পাঁচ দফা নিয়মাবলি (গাইডলাইন) এসেছে। নিয়মাবলির দ্বিতীয় দফায় উল্লিখিত নির্দেশনা আছে।

আইনের সংস্পর্শে আসা (অপরাধের শিকার বা সাক্ষী শিশু) কিংবা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর (অপরাধের যুক্ত শিশু) বয়স নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট বিচারককে এই পাঁচ দফা নিয়মাবলি অনুসরণ করতে বলেছেন হাইকোর্ট।

বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায়টি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

একটি মামলায় এক প্রতিপক্ষের (আসামি) বয়সের সঠিকতা নির্ণয়ে তার স্কুলের ভর্তির রেজিস্ট্রার ও হাজিরা খাতা তলব চেয়ে করা আবেদন নামঞ্জুর করে শিশু আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলটি করেছিলেন বাদী।

রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, শিশু আইনের ২১ ধারার বিধান অনুযায়ী, কেউ অভিযুক্ত হোক বা না-হোক, কেবল কাউকে শিশু হিসেবে অভিহিত করার অধিকার শুধু শিশু আদালতকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী কী ধরনের সনদ বা তথ্য–উপাত্তের আলোকে বয়স নির্ধারণ করা হবে, তার সুস্পষ্ট বা সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা এই ধারায় উল্লেখ নেই। তাই কিছু নির্দেশনা দেওয়া আবশ্যক বলে হাইকোর্ট মনে করেন। এ ক্ষেত্রে শিশু আদালতের বিচারক কাউকে শিশু নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে এই নিয়মাবলি অনুসরণ করবেন।

সর্বপ্রথম প্রাধান্য পাবে জন্মসনদ

নিয়মাবলির প্রথম দফায় বলা হয়, ২০১৩ সালের শিশু আইনের ২১ ধারার বিধান অনুযায়ী, কেবল শিশু আদালত আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর বয়স নির্ধারণ করতে পারবেন। কাউকে শিশু হিসেবে ঘোষণা করার অধিকার এই আদালতের থাকবে।

তৃতীয় দফায় বলা হয়, আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত কোনো শিশুর বয়স নির্ধারণে সর্বপ্রথম তার জন্মসনদ প্রাধান্য পাবে। রায় অনুযায়ী, সে ক্ষেত্রে শিশুর জন্মসনদ ২০০৪ সালের জন্মমৃত্যু নিবন্ধন আইনের ৮ ধারার বিধান অনুযায়ী ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন হতে হবে। অথবা ১৩ ধারার বিধান অনুযায়ী, দুই বছরের মধ্যে বিলম্ব ফি দিয়ে জন্মনিবন্ধন করতে হবে। অথবা ২০০৬ সালের জন্মমৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালার ৬, ৭, ৮ ও ৯ ধারার বিধান অনুযায়ী নিবন্ধন হতে হবে।

আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত কোনো শিশুর শিক্ষাগত সনদে উল্লেখিত জন্মতারিখ এবং জন্মমৃত্যু নিবন্ধন আইনের বিধানমতে নিবন্ধিত জন্মসনদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে জন্মসনদ প্রাধান্য পাবে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন আদালত।

চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, জন্মনিবন্ধনের জন্মতারিখ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদের জন্মতারিখ ও আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর বাহ্যিক অবয়ব-শারীরিক গঠন আপাতদৃষ্টে সাংঘর্ষিক বলে মনে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি রেজিস্ট্রার ও ছাত্রছাত্রীর হাজিরা খাতা তলব করে মিলিয়ে দেখতে হবে। তা সম্ভব না হলে সরকারি মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে গঠিত বোর্ডের মাধ্যমে বয়স নির্ধারণ করতে হবে।

রায়ে আদালত বলেছেন, আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত কোনো শিশু বা ব্যক্তিকে যদি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার বিধানমতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধের জন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করা হয়; কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বয়স নির্ধারণের কোনো অকাট্য বিশ্বাসযোগ্য দলিল উপস্থাপন না করা হয়, সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার বিধানমতে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার আগে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর বয়স নির্ধারণে শিশু আইনের বিধান অনুযায়ী উপরিউক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, শিশু আদালত কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত কোনো শিশুর বয়স নির্ধারণে উপরিউক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করবেন।

যে আপিল সূত্রে নির্দেশনা

নথিপত্র থেকে জানা যায়, জমিজমা নিয়ে বিরোধের সূত্রে মারধর এবং মো. রাকিব হোসেনকে (২৫) হত্যার অভিযোগে মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে জিহাদসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীর দশমিনা থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী নিহত ব্যক্তির বাবা আবদুস সাত্তার।

মামলায় ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র এবং একজনের ক্ষেত্রে দোষীপত্র দেন। দোষীপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করে বাদীপক্ষ, যা ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ ম্যাজিস্ট্রেট নামঞ্জুর করেন। আরিফুলকে শিশু হিসেবে অভিহিত করে দোষীপত্র গ্রহণ করা হয়। এ আদেশের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করে বাদীপক্ষ। রিভিশন মঞ্জুর করে আরিফুলের বয়স নির্ধারণে আবার তদন্তে দশমিনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

আরিফুলের বয়স নির্ধারণে ফিজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা।

মামলাটি দায়রা মামলা হিসেবে নিবন্ধিত হয়। অভিযোগ গঠনের সময় পটুয়াখালীর দায়রা জজ ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর আরিফুলের বয়স নির্ধারণে মামলার নথি শিশু আদালতে পাঠাতে ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন।

মামলাটি পাঠানো হলে পটুয়াখালীর শিশু আদালত ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শুনানির জন্য তারিখ ধার্য করেন। সেদিন আরিফুলের ভর্তি রেজিস্ট্রার ও ছাত্রছাত্রীর হাজিরা খাতা স্কুল থেকে তলবের জন্য বাদীপক্ষ দরখাস্ত করলে তা নামঞ্জুর হয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন মামলা বাদী আবদুস সাত্তার।

এই আপিল মঞ্জুর করে দেওয়া রায়ে হাইকোর্ট বলেন, পটুয়াখালীর শিশু আদালতের বিচারক প্রতিপক্ষের (আরিফুল) তথা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর বয়স নির্ধারণে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তা ন্যায়সংগত ও আইনানুগ নয়। শিশু আদালতের ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারির আদেশ রদ ও রহিত করা হলো। যদি আদালত মনে করেন, তাহলে প্রতিপক্ষের বয়স পুনর্নির্ধারণে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন।

হাইকোর্টে আবদুস সাত্তারের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম। আরিফুলের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান ও আইনজীবী আরিফ মঈনুদ্দীন চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আবদুল আজিজ মিয়া ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান।

পূর্ণাঙ্গ রায়টি হাতে পেয়েছেন বলে জানান সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় ১৬৪ ধারায় আরিফুল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তাঁর বয়স ১৯ বছর উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা প্রথম অভিযোগপত্রে শিশু নির্ধারণ করে তাঁর বিরুদ্ধে দোষীপত্র দাখিল করেন, যেখানে তাঁর বয়স সাড়ে ১৫ বছর উল্লেখ করা হয়। বয়সের সঠিকতা নির্ণয়ে আরিফুলের স্কুলের ভর্তির রেজিস্ট্রার ও হাজিরা খাতা তলবের জন্য বাদীপক্ষ শিশু আদালতে আবেদন করে। আরিফুলের পিইসি, জেএসসি ও এসএসসি সনদে উল্লেখিত জন্মতারিখকে প্রাধান্য দিয়ে আদালত সেই দরখাস্ত নামঞ্জুর করেন। আরিফুলের বয়স ১৮ বছরের নিচে নির্ধারণ করেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষের করা আপিল মঞ্জুর করে হাইকোর্ট রায় দেন। একই সঙ্গে শিশুর বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারককে এই নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে বলা হয়েছে, যা শিশুর বয়স নির্ধারণে সহায়ক হবে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আরিফ মঈনুদ্দীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলেও তা এখনো হাতে পাইনি। রায় হাতে পাওয়ার পর মক্কেলের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বয়স কম দেখানোর প্রবণতা প্রকট

বর্তমান পদ্ধতিতে অনেকেই ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে থাকেন, যা অহরহ ঘটে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট।

রায়ে বলা হয়, ছেলেমেয়েদের একাডেমিক বর্ষ তথা লেখাপড়া শেষ করার পরে যাতে তাদের চাকরির বয়স বিদ্যমান থাকে, সে উদ্দেশ্যে মা–বাবা-শুভানুধ্যায়ীরা তাদের বয়স কমিয়ে কাগজপত্র তথা জন্মসনদ সৃজন করেন। আরও লক্ষণীয় যে ভালো স্কুল তথা উন্নত স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার জন্য একাধিকার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকার কারণে এবং এই সুযোগ গ্রহণের সুবিধার্থে ছেলেমেয়েদের বয়স কম দেখানোর প্রবণতা প্রকটভাবে দেখা যায়। জন্মসনদ বা একাডেমিক সনদে উল্লেখিত জন্মতারিখ সঠিকতার ক্ষেত্রে বিরাট প্রশ্নবোধক সৃষ্টি করে।