সাধারণভাবে বাংলাদেশের গ্রাম বলতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, সহজ-সরল জীবন ও দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত একটি ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। আর শহর বলতে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে যুক্ত এবং আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। কিন্তু বিষয়টি যত সরলভাবে পাঠ করা হয়, তা ততটা সহজ নয়। বাংলাদেশের গ্রাম এখন দেশীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতি, পুঁজি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের পরিবর্তনকে বুঝতে হলে গ্রামের এই পরিবর্তনকে বুঝতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ বুধবার অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় গ্রাম–গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। আয়োজনে সভায় মূল বক্তব্য তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযুক্ত শিক্ষক ড. জহির আহমেদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুন নাহার ও রনজন সাহা পার্থ আলোচনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এতে বক্তব্য দেন।
অধ্যাপক জহির আহমেদ প্রায় তিন দশক আগে চরাঞ্চলে গ্রামীণ কৃষকের লৌকিক জ্ঞান নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করেন। সম্প্রতি তিনি গ্রামীণ মানুষের অভিবাসন অনুসন্ধানে আগের গবেষণা এলাকায় আবারও যান। এই সময়ের মধ্যে গ্রামীণ রূপান্তর কেমন হয়েছে, তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, গ্রামীণ সমাজের একটি বড় পরিবর্তন এসেছে আশি ও নব্বইয়ের দশকে। ওই সময়ে প্রবাসী আয় এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে। গত এক যুগে তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিযন্ত্র এবং দেশীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কৃষিপণ্য এখন আর শুধু কৃষকের নিজের খাওয়া–পরা বা হাটে–বাজারে বিক্রির পণ্য নয়। এটি দেশের বড় বড় কোম্পানির আগাম কিনে নেওয়া পণ্য হয়ে উঠেছে।
অধ্যাপক আইনুন নাহার প্রায় দুই যুগ আগের ওই গবেষণায় গ্রামে এনজিওর বিস্তার এবং নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে আলোকপাত করেন। মূল বক্তব্যে গ্রাম–সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে তিনি বলেন, শহরের মধ্যেও একসময় গ্রামের ধারণা ছিল। নব্বইয়ের দশকেও মোহাম্মদপুর ও মিরপুরকে পুরান ঢাকার অধিবাসীরা গ্রাম হিসেবে দেখতেন। তারও আগে গুলশান ও বনানীর মতো এলাকা গ্রাম হিসেবে ছিল। এখন মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের পরে শহরের মধ্যে ও চারপাশে বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে।
অধ্যাপক রঞ্জন সাহা পার্থ বলেন, বাংলাদেশের গ্রাম গবেষণা করতে গেলে সাধারণভাবে উত্তরাঞ্চল বা মধ্যাঞ্চলকে বোঝানো হয়। দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে কেউ কাজ করতে গেলে তা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয় হয়ে ওঠে। উপকূলীয় এলাকায় গেলে তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। শহরের মধ্যে যাঁরা বস্তিতে থাকেন, তাঁদের মধ্যেও গ্রামীণ সংস্কৃতি ও সম্পর্কগুলো দেখা যায়। ফলে গ্রাম বলতে যে সাধারণীকরণ করা হয়, তা সব সময় ঠিক নয়।