এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে যেসব জুলুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের ঘটনা ঘটেছে—সেগুলোর প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসা দরকার। এই সত্য উন্মোচনের জন্য প্রয়োজন একটি ট্রুথ কমিশন গঠন। আজ বুধবার সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে ‘সত্য, ন্যায় ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সভায় বক্তারা বলেন, অতীতের জুলুম–অত্যাচারের প্রকৃত ঘটনা এ জন্য বেরিয়ে আসা প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন কিছু না করে। তবে তারা এ–ও বলেছেন, বাংলাদেশে বিচার চাওয়া সহজ কিন্তু পাওয়া কঠিন।
আওয়ামী লীগের আমলে নানা কারণে হয়রানি করার বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে মন্তব্য করেন আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, এখনো অনেক অন্যায় হচ্ছে। রাতারাতি হয়তো এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। পরিবর্তনের জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, একটা গোষ্ঠী অনলাইনে এমনভাবে প্রচার চালাচ্ছে যে জুলাই–আগস্টে কিছুই হয়নি। নানাভাবে বলার চেষ্টা করছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাই ঘটেনি।
জুলাই–আগস্টে বাংলাদেশে কী হয়েছিল, তা তদন্তে গঠিত জাতিসংঘের কমিটি আগামী মাসে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে জানিয়ে সারা হোসেন বলেন, এ সময় বাংলাদেশে কী হয়েছিল তা পৃথিবী দেখার সুযোগ পাবে। গণহত্যা নিয়ে ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘ তদন্ত করছে।
বাংলাদেশে ট্রুথ কমিশন হওয়া উচিত বলে মত দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, সত্য উদ্ঘাটনে অনেক দেশের ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত সময় লেগেছে। এরপরও এই উদ্যোগটা নেওয়া উচিত।
শফিকুল আলম বলেন, আওয়ামী লীগ এখনো স্বীকার করছে না তারা কী পরিমাণ অপরাধ করেছে। তারা বলছে, হাজার হাজার পুলিশ মারা গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার এখন পর্যন্ত ৪৪ জন পুলিশের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আরও কেউ মারা গেলে তাঁদের স্বজনদের যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান তিনি।
গত ১৫ বছরে দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, রামুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তে যাদের নাম এসেছে, তারা প্রত্যেকে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা ছিলেন। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলার প্রাচীন ১২টি বৌদ্ধবিহারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত তার নিষ্পত্তি হয়নি।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, জুলাই–আগস্টের হত্যাকাণ্ডে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। বনশ্রী এলাকায় বিজিবি সদস্যদের গুলি করে মানুষকে গুরুতর আহত করতে দেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সত্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে এসব বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত।
আলোচনা সভায় সাংবাদিক তাসনিম খলিল বলেন, আয়নাঘরের তত্ত্বাবধায়কদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা ক্যান্টনমেন্টে বসে আছে। তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ও র্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম নিয়ে নিজেদের সত্যটা কবে জাতির সামনে উপস্থাপন করবে, সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তাসনিম খলিল বলেন, দেড় দশক ধরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল, তারা যদি নিশ্চয়তা পান যে তাদের নিয়ে নোংরা রাজনীতি করা হবে না, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে, তাহলে অনেকে সত্য বলবেন। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা এখনো ফিরে আসেননি, তাঁরা মৃত নাকি জীবিত, সেই সত্য সামনে আনা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মেয়ে শামারুহ মির্জা। তিনি তাঁর প্রবন্ধে ট্রুথ কমিশন গঠনের জন্য একটি খসড়া ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এতে তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্তরে যে অনাচার হয়েছে, যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরাময়ের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত সত্য উন্মোচন। গণহত্যা, গুম, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর প্রকৃত চিত্র সামনে আসা উচিত। জবাবদিহি ও সত্য উন্মোচন অনিবার্য হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কীভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব, সেই পথও ঠিক করা জরুরি।
ডায়াসপোরা অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি ও বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের যৌথ আয়োজনে সভায় আরও বক্তব্য দেন আইনজীবী সাকিব মাহবুব। সঞ্চালনা করেন সাইয়েদ আবদুল্লাহ।