গম আমদানি নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা

রাশিয়া-ইউক্রেন শস্য চুক্তি নবায়ন না হলে বিপদে পড়তে পারে বাংলাদেশ। আর এই অনিশ্চয়তায় দেশে বেড়েছে আটার দাম।

ইউক্রেন থেকে নিরাপদে শস্য রপ্তানির চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৮ মার্চ। এই চুক্তি নবায়নে রাশিয়ার নতুন শর্তে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। রাশিয়া বলেছে, শস্য চুক্তি নবায়ন করবে, যদি তার দেশের শস্য ও সার রপ্তানিতে বাধা দূর করা হয়। ফলে চুক্তি নবায়ন না হলে বেশি বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। কারণ, ভারতের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আটা তৈরির সস্তা গম আমদানিতে এখন অন্যতম বড় উৎস ইউক্রেন।

দেশে মোট আমদানির ৭০ শতাংশই আটা তৈরির গম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এই গমের একমাত্র উৎস হয়ে ওঠে ভারত। বিধিনিষেধের কারণে ভারত থেকে গম আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে নভেম্বরের শুরুতে। তবে শস্য চুক্তির আওতায় ইউক্রেন থেকে গম আমদানি শুরু হওয়ায় ঘাটতি থাকলেও ভয়াবহ সংকট হয়নি।

আবার দামেও বিশ্ববাজারে এখন সবচেয়ে সস্তা ইউক্রেন-রাশিয়ার গম। দেশ দুটি থেকে প্রতি কেজি গম আমদানিতে বন্দর পর্যন্ত খরচ পড়ছে ৩৭ টাকা। রাশিয়া থেকে বেসরকারি খাতে আমদানিতে সব ব্যাংক ঋণপত্র খুলছে না। ইউক্রেনে এ সমস্যা নেই। এখন কোনো কারণে চুক্তি নবায়ন না হলে কম দামে আটা তৈরির গম যেমন মিলবে না, তেমনি সরবরাহেও ধাক্কা আসবে। এতে আটার পাশাপাশি গমের তৈরি সব ধরনের খাবারের দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

চুক্তির মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার আগে ইউক্রেন থেকে আমদানিতে রাশিয়ার কারণে কিছুটা প্রক্রিয়াগত বিলম্ব হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে ইউক্রেন। এতে বাংলাদেশেও গমের সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। তাতে দুই দিন আগে দেশে আটার দাম কেজিতে ২–৩ টাকা বেড়ে ৫৮-৬০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

ইউক্রেন থেকে গম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া চুক্তিতে না থাকলে ইউক্রেন থেকে আমদানির সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া থেকে গম আমদানি বাড়াতে হবে। তবে রাশিয়া থেকে আমদানিতে সব ব্যাংক ঋণপত্র খুলছে না।

বিষয়টি নিয়ে সরকারকে এখনই তদারকি শুরু করতে হবে। অন্যথায় বিকল্প দেশগুলো থেকে আমদানিতে খরচ বেড়ে যাবে, যা সাধারণ ভোক্তাদের ওপর পড়বে।

আরও পড়ুন

মেয়াদ বাড়াতে চায় ইউক্রেন, রাশিয়া দিচ্ছে শর্ত

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে দেশে দেশে খাদ্যসংকট তৈরির শঙ্কা দেখা দিলে গত বছরের ২২ জুলাই জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের তিনটি বন্দর দিয়ে নিরাপদে শস্য রপ্তানিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। চুক্তির পর গত ১ আগস্ট ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি শুরু হয়। গত ১৭ নভেম্বর চার মাসের জন্য একদফা নবায়ন হয়, যা শেষ হবে ১৮ মার্চ।

কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করে রেখেছে রাশিয়া। চুক্তি নবায়ন না হওয়ার অর্থ ইউক্রেনের বন্দর থেকে কোনো শস্যবাহী জাহাজ বিশ্বের কোনো দেশে যেতে দেবে না রাশিয়া। আবার চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে ঝুঁকি নিয়ে কোনো বাণিজ্যিক জাহাজও ইউক্রেন থেকে পণ্য পরিবহনে রাজি হবে না। কৃষ্ণসাগর এড়িয়ে সাগরপথে বিকল্প রুট নেই ইউক্রেনের।

এমন পরিস্থিতিতে এই চুক্তি নতুন করে এক বছর বাড়াতে চায় ইউক্রেন। এ রকম এক সময়েই চুক্তি নবায়নে রাশিয়া নতুন করে শর্ত দিয়েছে। গত বুধবার রয়টার্সের খবরে বলা হয়, রাশিয়া শস্য চুক্তি নবায়ন করবে, যদি তার দেশের শস্য ও সার রপ্তানিতে বাধা দূর করা হয়। রাশিয়া বলছে, রপ্তানিতে আর্থিক লেনদেন, অবকাঠামো ও বিমার ওপর নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে রাশিয়ার শস্য ও সার রপ্তানিতে বড় বাধা। বাধাহীনভাবে বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হলেই কেবল দেশটি চুক্তিতে ফিরবে বলে ওই খবরে বলা হয়। চুক্তির মেয়াদের সময় কমে এলেও এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

পরিদর্শনে রাশিয়ার গাফিলতি, ভুক্তভোগী বাংলাদেশও

চুক্তি অনুযায়ী, খালি জাহাজ ইউক্রেনের বন্দরে যাওয়ার আগে প্রথমে তুরস্কের উপকূলে যৌথ সমন্বয় কেন্দ্রের (জেসিসি) মাধ্যমে রাশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা খালি জাহাজ পর্যবেক্ষণ ও তল্লাশির কাজ করেন। আবার ইউক্রেনের বন্দরে শস্য বোঝাই করে গন্তব্যে যাওয়ার আগে পুনরায় তল্লাশি করা হয়। ইউক্রেনের পররাষ্ট্র ও অবকাঠামো উন্নয়ন মন্ত্রণালয় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, রাশিয়ার গাফিলতিতে এক মাস ধরে শস্য চুক্তির জাহাজ পরিদর্শনে বিলম্ব হচ্ছে।

সাধারণত ইউক্রেন থেকে শস্য আমদানিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত ২১ দিন সময় লাগে। এখন এই সময় লাগছে এক মাসের বেশি। আবার খালি জাহাজ তল্লাশিতে দেরি হওয়ায় কোনো ক্ষেত্রে দুই মাসের বেশি সময় লাগছে।

যেমন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বিএসএম গ্রুপের গম আমদানির জন্য একটি খালি জাহাজ তুরস্কের উপকূলে পৌঁছায় গত ২১ জানুয়ারি। জাতিসংঘের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, জাহাজটি পরিদর্শন হয় ৩৭ দিনের মাথায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। এই জাহাজ ইউক্রেনের ওদেসা বন্দরে পৌঁছেছে ১ মার্চ। সেখান থেকে গম বোঝাই করে ফেরার পথে আবার পরিদর্শনে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে। অর্থাৎ দুই মাসের বেশি সময় লাগছে এই জাহাজের। আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে জানান, এই বিলম্বে কেজিতে দুই টাকা বাড়তি খরচ হবে।

এদিকে চট্টগ্রামের স্মাইল ফুড প্রডাক্টসের গম আমদানির জন্য আরেকটি জাহাজ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের উপকূলে পৌঁছেছে। এই জাহাজও এখনো পরিদর্শনের তালিকায় ওঠেনি।

ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানিতে দেরি হওয়ায় ও চুক্তি নবায়নে অনিশ্চয়তায় সরবরাহে প্রভাব পড়ছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ সংকটে গমের দাম বাড়ছে। যে গম আমদানিতে খরচ পড়ছে ৩৭ টাকা, তা পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, আটার দামও খুচরা বাজারে কেজিতে ২–৩ টাকা বেড়ে ৫৮-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চুক্তির আওতায় গম আমদানিতে তৃতীয় বাংলাদেশ

জাতিসংঘের ওয়েবসাইটের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চুক্তি কার্যকরের পর থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের ৪৫টি দেশ ইউক্রেন থেকে ২ কোটি ২৭ লাখ টন শস্য আমদানি করেছে। চুক্তির আওতায় শস্য আমদানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পর্যন্ত অষ্টম।

মোট শস্যের মধ্যে ইউক্রেন গম রপ্তানি করে ৬৩ লাখ টন। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ১১টি জাহাজে ৬ লাখ টন গম আমদানি করেছেন। এর মধ্যে চারটি জাহাজ এখনো চট্টগ্রামের পথে রয়েছে। গম আমদানিতে স্পেন ও তুরস্কের পরই রয়েছে বাংলাদেশ। ইউক্রেনের মোট গম রপ্তানির ১০ শতাংশ এসেছে বাংলাদেশে।

আগস্টে চুক্তি কার্যকর হলেও বাংলাদেশে প্রথম জাহাজ ইউক্রেন থেকে বন্দরে পৌঁছায় গত অক্টোবরে। বসুন্ধরা গ্রুপ ‘এমভি ইনচে আকডেনিজ’ জাহাজে প্রথম ৫৫ হাজার টন গম আমদানি করে। এরপর মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ বা এমজিআই, আবুল খায়ের, এস আলম, সিটি, টিকে গ্রুপসহ ১১টি শিল্পগ্রুপ গম আমদানি করে।

সস্তা গমের সরবরাহ ঝুঁকিতে

দেশে বছরে গম উৎপাদিত হয় প্রায় ১১ লাখ টন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বছর বাদ দিলে বছরে গড়ে গম আমদানি হয় ৬৯ লাখ টন। আমদানি হওয়া এই গমের ৭০ শতাংশই আটা তৈরির সাধারণ আমিষযুক্ত গম।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, গত অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে গম আমদানি হয় ২২ লাখ টন। এর মধ্যে ২৪ শতাংশ বা সোয়া ৫ লাখ টন আমদানি হয় ইউক্রেন থেকে। রাশিয়া থেকে আমদানি হয় ৩৮ শতাংশ বা ৮ লাখ ২৯ হাজার টন। রাশিয়া থেকে সরকারি চুক্তির আওতায় সিংহভাগ গম আমদানি হয়েছে। বেসরকারি খাতে শুধু দুটি প্রতিষ্ঠান গম আমদানি করতে পেরেছে।

এখন রাশিয়া-ইউক্রেন ছাড়া কম দামের গম আমদানির বিকল্প উৎস রয়েছে কৃষ্ণসাগরের আশপাশের দেশগুলো। চুক্তি নবায়ন না হলে এসব দেশ থেকে গম আমদানিতে বাড়তি খরচ করতে হবে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। সে ক্ষেত্রে বেশি দামি গমে নির্ভরতা বাড়তে পারে।

বিকল্প কী

এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি নবায়ন না হলে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাবে। খাদ্যশস্য সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হলে এখনই বিকল্প দেশগুলো থেকে আমদানিতে যেসব জটিলতা রয়েছে, তা দূর করাসহ আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। তাতে যেকোনো সমস্যা হলে যাতে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।