স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত
এত অভিযোগ, শেষে বিভাগীয় মামলা, তবু তিনি বহাল
ফাতেমা দোজা ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন।
ফাতেমা দোজার কর্মস্থলে উপস্থিতির হাজিরা খাতায় সই নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণপত্র জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।
২০ বছর ধরে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ার একাধিক অভিযোগ। গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ফৌজদারি মামলায় কারাবাসের তথ্য গোপন, স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে দেড় বছর পর আবার একই হাসপাতালে যোগদান, বিদেশে সেমিনারে যোগদানের ভুয়া আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ ইত্যাদি নানা অনিয়ম ও অসদাচরণের অভিযোগের পরও তিনি চাকরি করে যাচ্ছেন। পাচ্ছেন নিয়মিত বেতন-ভাতা, কপালে জুটেছে পদোন্নতিও।
এই চিকিৎসকের নাম ফাতেমা দোজা। তিনি কর্মরত আছেন রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক (রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং) হিসেবে। একাধিক তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
ডা. ফাতেমা দোজা চাকরি ছাড়ার দেড় বছর পর আবার কাজে যোগ দেন। অনুপস্থিত থাকাকালীন ছুটিও নেননি। তবু বহাল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফাতেমা দোজা ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন। এর প্রায় দেড় বছর পর ২০১৩ সালের ১১ জুন আবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে উচ্চতর পদে (সহকারী অধ্যাপক) যোগ দেন। কিন্তু এই সময়ে তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চাকরিতে অনুপস্থিত ছিলেন এবং বেতন–ভাতাও উত্তোলন করেননি। অনুপস্থিত থাকাকালে ছুটি মঞ্জুরের কোনো আবেদনের কপিও পাওয়া যায়নি। তবে চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন এবং তাঁর আবেদনপত্রটি হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠিয়েছেন, ওই চিকিৎসক লিখিত বক্তব্যে তা স্বীকার করেছেন।
হৃদরোগ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের হাজিরা খাতা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ওই সময়ে ফাতেমা দোজার কর্মস্থলে উপস্থিতির হাজিরা খাতায় সই নেই। অর্থাৎ ওই সময়ে তিনি হৃদরোগ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন না। বিধি অনুযায়ী, এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তিনি কিছুই অবহিত করেননি।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ফাতেমা দোজার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোর পরিচয় জেনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর ফোন বন্ধ করে দেন। তাঁর মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের রেডিওলজি সোসাইটির বার্ষিক সভা ও বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণপত্র জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে ডা. ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে। এই আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে বিদেশে যেতে চাইলে স্বাস্থ্য বিভাগ আয়োজক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে, আমন্ত্রণপত্রটি ভুয়া।
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বিন্নাকুড়ি গ্রামের ১০ বছরের গৃহকর্মী মোস্তাকিনাকে গরম ইস্তিরি দিয়ে পুড়িয়ে গুরুতর জখম করার অভিযোগ ছিল ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে। ২০০৪ সালের মে মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রমনা থানায় মামলা হলে তিনি গ্রেপ্তার হন। ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার ও কারাবন্দী হওয়ার তথ্য তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন করেন। কারামুক্ত হওয়ার পর ব্যক্তিগত অসুবিধার কথা উল্লেখ করে চার মাস আট দিনের অর্জিত ছুটির আবেদন করেন এবং আবার কাজে যোগ দেন।
সর্বশেষ গত ১০ মার্চ ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের শৃঙ্খলা অধিশাখার এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানা যায়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মঞ্জুরুল হাফিজকে এই বিভাগীয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। মঞ্জুরুল হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। এ ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলতে পারব না।’
যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘বারবার অপরাধ করার পরেও কেন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বিষয়টি আমরা অবশ্যই খতিয়ে দেখব।’