আজ গণহত্যার বিভীষিকাময় কালরাত
আজ বিভীষিকাময় সেই কালরাত। ১৯৭১ সালে এমনি এক দিনের শেষে রাজধানীর কর্মক্লান্ত মানুষ যখন ছিলেন গভীর নিদ্রায় অচেতন, তখন সেই নিরপরাধ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাংক, মর্টার, মেশিনগান, রাইফেলসহ অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের হানাদার বর্বর সেনাবাহিনী। নির্বিচার তারা বিভিন্ন স্থানে চালিয়েছিল গণহত্যা। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে রাতের বাতাস। একটি রাতে এমন বর্বর গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সময়ের গতিপথ বেয়ে ৫৪ বছর পরে আবার ফিরে এল সেই জিঘাংসা, মৃত্যু, বর্বরতা ও শোকাচ্ছন্ন রাতের স্মৃতিজাগানিয়া ২৫ মার্চ। জাতির ইতিহাসে বেদনাবিধুর এই রাত চিহ্নিত হয়ে আছে ‘কালরাত’ হিসেবে। সরকারিভাবে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে।
পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকারের দাবি কখনো মেনে নিতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভেতর দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের ওপরে শোষণ ও দমন–পীড়ন চালাতে থাকে। প্রথমেই তারা আঘাত হেনেছিল বাঙালির মাতৃভাষার ওপর। বুকের রক্ত দিয়ে জাতির বীর সন্তানেরা মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল স্বাধিকারের চেতনায়। ক্রমে তা রূপ নেয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। মুক্তিকামী বাঙালিকে চিরতরে দমন করে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিক ও সেনাবাহিনী। তারা বেছে নেয় গণহত্যার পৈশাচিক পথ।
সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুরু করে তাদের কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’। মৃত্যুদূতের মতো ট্যাংক বেরিয়ে আসে সেনানিবাস থেকে। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে গর্জে ওঠে মেশিনগান-রাইফেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের প্রধান হামলার স্থল। ঘুমন্ত ছাত্র–শিক্ষকদের গুলি করে হত্যা করে তারা। গণহত্যার পৈশাচিকতায় মেতে ওঠা ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নীলক্ষেত এলাকা, রাজারবাগের পুলিশ লাইনস, পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তরেও হামলা চালিয়ে গণহত্যা চালায়। গণহত্যা ছাড়াও সেই রাতে তারা ঢাকার বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও গণহত্যা শুরু করে হানাদার ঘাতকেরা। বলা হয়ে থেকে, ২৫ মার্চ এক রাতেই প্রায় অর্ধলাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল তারা।
বাণী
গণহত্যা দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে বিশ্বের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
সেই কালরাতের শহীদদের স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সেদিন মধ্যরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা “অপারেশন সার্চলাইট” পরিচালনা করে ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, রাজারবাগসহ সারা দেশে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলায় শহীদ হন ছাত্র-শিক্ষক, পুলিশ ও সেনাসদস্যসহ হাজারো নিরপরাধ মানুষ। তাঁদের আত্মদানের পথ ধরেই দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।’
বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নতুন বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে—গণহত্যা দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
কর্মসূচি
গণহত্যা দিবস পালনের লক্ষ্যে আজ সারা দেশে রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট (১ মিনিটের) প্রতীকী ব্ল্যাকআউট (কেপিআই—জরুরি স্থাপনা ছাড়া) পালন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে সারা দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরিসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
কালরাত স্মরণ উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন তাদের কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে গণহত্যার কালরাত স্মরণে বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে ‘ভুলি নাই ভুলি নাই মৃত্যু মিছিল: জেনোসাইড একাত্তর দায়বদ্ধতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম’ শীর্ষক আলোক প্রজ্বালন ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
বাংলা একাডেমি স্বাধীনতা ও গণহত্যা দিবস উপলক্ষে বেলা তিনটায় সেমিনারের আয়োজন করেছে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে।