আদালত প্রাঙ্গণে ক্ষোভের মুখে দীপু মনি
হুইসেল বাঁজিয়ে মঙ্গলবার বেলা তিনটার পর একটি সাদা মাইক্রোবাস ঢাকার চিফ মেট্রপলিটন (সিএমএম) আদালতের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়ায়। মাইক্রোবাসের সামনে পুলিশের একটি ভ্যান। আর মাইক্রোবাসের পেছনে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান।
তখন আদালতের প্রধান ফটকের সামনে শতাধিক ব্যক্তি ও আইনজীবী সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনির ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে দীপু মনির নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর থেকে আসা বেশ কয়েকজন ছিলেন। একপর্যায়ে তাঁরা সাদা মাইক্রোবাসটি ঘিরে রাখেন। কেউ কেউ পায়ের জুতা হাতে নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। তখন পুলিশি পাহারায় মাইক্রোবাসটি ধীরে ধীরে আদালতের হাজতখানার ভেতরে ঢুকে পড়ে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য হাজতখানা থেকে প্রথমে সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয়কে নিয়ে আদালত কক্ষের দিকে রওনা হন।
আরিফ খানের মাথায় ছিল পুলিশের হেলমেট। তাঁর গায়ে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। এরপর হাজতখানা থেকে বের করা হয় সাবেক মন্ত্রী দীপু মনিকে। তাঁরও মাথায়ও ছিল হেলমেট। আর গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। মুখে ছিল মাস্ক। পুলিশের সামনে থাকা গণমাধ্যমকর্মীরা আরিফ খান জয় ও দীপু মনির ছবি তুলতে থাকেন। এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক আইনজীবীরা দীপু মনি ও আরিফ খান জয়কে ঘিরে ধরেন। এমন অবস্থায় প্রথমে আরিফ খানকে নিয়ে আদালতের দ্বিতীয় তলার একটি এজলাসকক্ষে প্রবেশ করে পুলিশ।
এরপর দীপু মনিকে নিয়ে পুলিশ যখন সিএমএম আদালতের প্রধান ফটকের সামনে আসে, তখন আইনজীবী ও বিক্ষুব্ধ লোকজনের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। পরে পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় দীপু মনিকে প্রধান ফটক হয়ে আদালতের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যেতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। নারী পুলিশ সদস্যরা তাঁকে সিঁড়ি দিয়ে উঠিয়ে দ্বিতীয় তলায় আদালতের এজলাসকক্ষে প্রবেশ করান। আদালতকক্ষে প্রবেশের পর আসামির কাঠগড়ায় পাশাপাশি রাখা হয় দীপু মনি ও আরিফ খানকে।
তখন মোহাম্মদপুরের মুদিদোকানি আবু সায়েদ হত্যা মামলায় দীপু মনি ও আরিফ খানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আদালতকে অবহিত করেন পুলিশের একজন পরিদর্শক। কেন তাঁদের ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়া হবে, তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তিনি। এ সময় দীপু মনি ও আরিফ খান ছিলেন নির্বাক। আদালতে দীপু মনির পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। তবে আদালতে উপস্থিত একজন আইনজীবী দীপু মনির পক্ষে কথা বলেন। এ সময় আরিফ খান কথা বলতে চাইলেও অনুমতি পাননি।
আদালতকক্ষে উপস্থিত বিএনপি–সমর্থক আইনজীবীরা দীপু মনি ও আরিফ খানের শাস্তির দাবি জানাতে থাকেন। একপর্যায়ে বিমর্ষ হয়ে পড়া দীপু মনি কেঁদে ফেলেন। প্রায় ১০ মিনিট শুনানি শেষে দীপু মনিকে চার দিন পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন আদালত। আর আরিফ খানের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড আদেশের পর এজলাসকক্ষ থেকে আরিফ খান ও দীপু মনিকে হাজতখানায় নেওয়ার উদ্যোগ নেয় পুলিশ। তাঁদের যখন দ্বিতীয় তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামানো হচ্ছিল, তার এক পর্যায়ে সিঁড়িতে পড়ে যান দীপু মনি। পরে নারী পুলিশ সদস্যরা তাঁকে টেনে তুলে আদালতে প্রবেশের প্রধান ফটকের সামনে আসেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত আইনজীবী ও বিক্ষোভকারীরা তাঁর দিকে তেড়ে যান। একজন দীপু মনির শাড়ির আঁচল টেনে ধরেন। পরে পুলিশ তাঁকে সরিয়ে নেন। এরপর আদালতের সামনে সাদা শার্ট পরা এক ব্যক্তি দুই দফায় দীপু মনিকে আঘাত করার চেষ্টা করেন। পরে দ্রুত পুলিশ তাঁকে হাজতখানার ভেতরে নিয়ে যায়।
আর আরিফ খানকে যখন আদালতের সামনে দিয়ে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল, তখন একজন আইনজীবী পেছন থেকে তাঁর ঘাড় বরাবর কিলঘুষি মারেন। পরে পুলিশ দ্রুত সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীকে হাজতখানায় নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর আরিফ খানকে প্রিজন ভ্যানে তুলে আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে পুলিশ। পরে দীপু মনিকে বহনকারী গাড়িটি আদালত চত্বর ত্যাগ করে। তখনো সাবেক শিক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির শাস্তি দাবিতে বিক্ষোভ করছিলেন কিছু ব্যক্তি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে মুদিদোকানি আবু সায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় ১৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করা হয়। ঢাকার সিএমএম আদালত অভিযোগ এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। পরে মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ মামলাটি রেকর্ড করে। এ মামলায় দীপু মনি ও আরিফ খান জয়কে রিমান্ডে পেল পুলিশ।