বেশি প্রবাসী আয় আসে যে দেশ থেকে, সে দেশেই কর্মী কমছে
সৌদি আরবের পর বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ থেকে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে। কিন্তু আমিরাতে প্রবাসী কর্মী পাঠাতে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে গত এক যুগে।
মাঝখানে টানা কয়েক বছর আমিরাতে নতুন কর্মী পাঠানো কার্যত বন্ধ ছিল। ২০২১ সাল থেকে এটি আবার বাড়তে শুরু করে। তবে এখন কর্মী পাঠানোর সংখ্যা কমছে। ফলে দেশটি থেকে পাঠানো প্রবাসী আয় কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে একটি চক্রের প্রতারণা করে কর্মীদের আমিরাতে পাঠানোসহ বিভিন্ন কারণে দেশটির নিয়োগকর্তাদের বাংলাদেশি কর্মী নিতে অনীহা তৈরি হয়েছে।
প্রবাসী আয়ের বিচারে আমিরাত শ্রমবাজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এপ্রিল পর্যন্ত আমিরাত থেকেই সর্বোচ্চ ৩৬৫ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ২৩৪ কোটি ডলার প্রবাসী আয়। আর শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে এসেছে ২১৬ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে বাংলাদেশি কর্মীদের। যদিও বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি দেশে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার আরব আমিরাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৭ শতাংশের বেশি কর্মীর। ১৯৭৬ সাল থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত দেশটিতে গেছেন ২৬ লাখ ২৮ হাজার ২১৮ বাংলাদেশি কর্মী।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আরব আমিরাতে ২০২২ সালে প্রতি মাসে কর্মী গেছেন প্রায় সাড়ে আট হাজার। পরের বছর ২০২৩ সালে যান গড়ে ৮ হাজার ২০০ কর্মী। আর এ বছর চার মাসে গেছেন গড়ে সাড়ে ছয় হাজার। টানা কয়েক বছর কর্মী পাঠানো কমে যাওয়ায় আয়ও কমেছিল মাঝখানে। ২০২১-২২ সালে দেশটি থেকে আয় এসেছে ২০৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এটি বেড়ে হয় ৩০৩ কোটি ডলার। কর্মী পাঠানো কমতে থাকলে ধীরে ধীরে প্রবাসী আয় কমে যেতে পারে। কর্মী পাঠানো কমার পর আয় কমতে দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কর্মী পাঠানোর সঙ্গে যুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা বলছেন, করোনা মহামারির পর আরব আমিরাত কর্মীদের নিতে ভ্রমণ ভিসা চালু করে। দেশটিতে পৌঁছানোর পর নিয়োগকর্তার মাধ্যমে আবেদন করে কর্মীদের ভিসা পরিবর্তন করে কর্মসংস্থান ভিসা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে একটি চক্র কর্মীদের প্রতারিত করতে থাকে। অনেক কর্মী দেশটিতে গিয়ে কাজ পাননি। তাঁরা রাস্তাঘাটে, পার্কে জীবনযাপন করতে থাকেন। এতে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। এ ছাড়া আরব আমিরাতের শ্রম আইনে অবৈধ হয়ে পড়া কোনো কর্মীর সঙ্গে দেশটির কোনো নিয়োগকর্তার সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাঁকে ৫০ হাজার দিরহাম জরিমানা করা হয়। এসব কারণে বাংলাদেশি কর্মী নিতে দেশটির নিয়োগকর্তাদের অনীহা তৈরি হয়।
রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আরব আমিরাত অদক্ষ খাতে কর্মী নিয়োগের ভিসা দেয় না। পেশাদার খাতে নিতে চায়, যেখানে কর্মীদের সনদের ঘাটতি আছে। যদিও দেশটিতে গিয়ে ভিসার ধরন বদলের সুযোগ থাকে। এসব জটিলতা দূর করে দেশটিতে কর্মী পাঠানো বাড়াতে দুই দেশের সরকারের মধ্য আলোচনা দরকার।
তবে আরব আমিরাতে কর্মী পাঠানো বাড়াতে কাজ করছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কর্মকর্তারা বলেন, গত ২৪ মে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আরব আমিরাত সফরে যান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। বিদেশি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে ২৫ মে দুপুরে একটি মতবিনিময় সভা করেন তিনি। মোটরবাইকের চালক ও গাড়িচালক হিসেবে আরও বেশি কর্মী পাঠানোর সুযোগ নিয়ে আলোচনা হয় ওই সভায়। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ খাতে দক্ষ কর্মী তৈরি করা হচ্ছে বলেও জানানো হয়। নিয়োগকর্তাদের তা পরিদর্শন করতে বাংলাদেশে সফরের আমন্ত্রণ জানান প্রতিমন্ত্রী।
বায়রার যুগ্ম মহাসচিব টিপু সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে অনেকেই কাজ পাননি। এটি ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। তাই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহ কমেছে।
২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন আরব আমিরাতে। প্রতিবছর দেশটিতে গেছেন দুই লাখের বেশি কর্মী। এর মধ্যে ২০০৮ সালে গেছেন চার লাখের বেশি কর্মী। এরপর কর্মীদের নিয়ে নানা অভিযোগের কারণে ২০১২ সালে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশিদের জন্য। দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমবাজারে কিছু কিছু করে কর্মী পাঠানো শুরু হয়। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে গড়ে ২৫ হাজার করে কর্মী গেছেন দেশটিতে। ২০১৬ থেকে এটি কমতে কমতে ২০২০ সালে ১ হাজারে নেমে আসে। ২০২১ সালে আবার শুরু হয় কর্মী পাঠানো।
তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে কর্মসংস্থান ভিসা নিতে দালালকে নতুন করে টাকা দিতে হয়েছে। পদে পদে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। সব মিলে আরব আমিরাতের নিয়োগকর্তারা বিরক্ত। দেশ থেকে কর্মী পাঠানোর নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অব্যবস্থাপনার কারণেই একের পর এক শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিয়োগের প্রক্রিয়া ঠিকঠাক করতে না পারলে আরও শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে।