চোরাচালান
সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে দেশে
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) গত ১০ মাসে উদ্ধার করে ৮৩টি অস্ত্র ও ৫৯৭টি গুলি।
এর মধ্যে পিস্তল ও রিভলবার ৩৪টি; রাইফেল, বন্দুকসহ অন্য অস্ত্র ৪৮টি।
২০২২ সালে পুলিশ উদ্ধার করে ৩,১৫২টি অস্ত্র।
২০২১ সালে উদ্ধার হয় ২,৩১০টি অস্ত্র।
সীমান্তের অন্তত ১৭টি পথ দিয়ে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে।
সীমান্ত পেরিয়ে রাজশাহীতে আসা বিদেশি অস্ত্রের একটি চালানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। ওই চালানে ছিল চারটি বিদেশি রিভলবার, তিনটি বিদেশি পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন, আটটি গুলি, আটটি গুলির খোসা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। ঘটনাটি গত ৭ অক্টোবরের।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানতে পারেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতার লক্ষ্যে অবৈধ এসব অস্ত্র আনা হয়েছিল।
৯ নভেম্বর সীমান্ত পেরিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ হয়ে দেশে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঢোকার সময় দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তাঁদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও দুটি ম্যাগাজিন জব্দ করা হয়। বিজিবি বলছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা কমিশনের বিনিময়ে সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র এনে এপারের অস্ত্র কারবারিদের হাতে তুলে দেন। অস্ত্র কারবারিদের হাত ঘুরে সেসব অস্ত্র পৌঁছে যায় অসাধু রাজনৈতিক নেতা, সন্ত্রাসী, জঙ্গি, ডাকাত, ভূমিদস্যুসহ অপরাধীদের হাতে।
সীমান্তে ও সীমান্ত এলাকায় মাঝেমধ্যে কিছু অস্ত্রের চালান ধরা পড়লেও বেশির ভাগ চালান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশে ঢোকে। বিজিবি সদর দপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত—১০ মাসে বিজিবি সারা দেশের সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ৮৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫৯৭টি গুলি উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে ৩৪টি পিস্তল ও ১টি রিভলবার। রাইফেল, বন্দুকসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে আরও ৪৮টি।
আর পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০২২ সালে পুলিশ সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ৩ হাজার ১৫২টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এর আগের বছর ২০২১ সালে ২ হাজার ৩১০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার বড় একটি উপকরণ হলো সীমান্তে দিয়ে দেশে অস্ত্র ঢোকা।ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এম এম খায়রুল কবির, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (জিএস শাখা), বিজিবি সদর দপ্তর
বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের অন্তত ১৭টি পথ দিয়ে দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। পথগুলো হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের রহনপুর, একই এলাকার সোনা মসজিদ, আজমতপুর, বিলভাতিয়া, ঝিনইদহের মহেশপুরের জুলুলী, সাতক্ষীরার কলারোয়ার তলুইগাছা, যশোরের বেনাপোল, চৌগাছা, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার শাঁকারা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং কুষ্টিয়ার সীমান্ত এলাকা।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে এরই মধ্যে সারা দেশে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
যেভাবে অস্ত্র আসে
৯ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তে গ্রেপ্তার দুজনের বিষয়ে বিজিবি জানায়, ওই দিন বিকেলে রহনপুর ব্যাটালিয়ন (৫৯ বিজিবি) গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে, আজমতপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান আসছে। এরপর বিজিবির একটি বিশেষ টহল দল তেলকুপি ঘাট এলাকায় অবস্থান নেয়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় দুই ব্যক্তিকে মোটরসাইকেলে কানসাটের দিকে যেতে দেখে বিজিবি থামার সংকেত দিলে তাঁরা পালানোর চেষ্টা করেন। বিজিবির সদস্যরা ধাওয়া দিয়ে জামরুল ইসলাম (৩৫) ও মাজির উদ্দীনকে (৪৩) গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও দুটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়।
৫৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর আওতাধীন সীমান্ত এলাকা পাঁচ কিলোমিটার। গত এক বছরে ওপার থেকে অস্ত্র নিয়ে দেশে ঢোকার সময় ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তের ওপার থেকে এপারে যাঁরা অস্ত্র নিয়ে আসেন, তাঁরা মূলত বাহক। তাঁরা বিজিবির টহল চলার সময় যে স্থান ফাঁকা হয়ে যায়, সেখান থেকে বা সেই এলাকার কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাহকেরা অস্ত্র নিয়ে আসেন। পরে সেটা মূল কারবারিদের হাতে তুলে দেন।
গত ৩১ মে রাতে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়ার তলুইগাছা সীমান্ত থেকে গুলিসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করে বিজিবি। এ প্রসঙ্গে বিজিবির ৩৩ ব্যাটালিয়ন জানায়, তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান আসার বিষয়টি জানতে পেরেছিল। সে অনুযায়ী গোপনে অবস্থান নিয়েও অস্ত্রের চোরাচালানকারীদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। আগ্নেয়াস্ত্র ফেলে তারা বনের মধ্যে পালিয়ে যায়।
গত ৭ অক্টোবর রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী থানার কাপাশিয়া পাহাড়পুরে অস্ত্রের চালানসহ যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব, তাঁরা হলেন কাপাশিয়া এলাকার মো. আতিকুর রহমান (৩৫), রাজশাহী নগরের চরকাজলা এলাকার মো. শাহীন আলী (২৫) ও নগরের কাজলার ধরমপুর এলাকার মো. শহিদুল (২৬)।
এ ঘটনায় র্যাব-৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার সেদিন সাংবাদিকদের বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরবঙ্গে জব্দ করা সবচেয়ে বড় অবৈধ অস্ত্রের চালান এটি। আটক ব্যক্তিরা চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ী। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে মো. তানজিম (২৭) ও মো. আবদুর রহিম (২৮) নামের দুই ব্যক্তির মাধ্যমে অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করে দেশে অস্ত্র সরবরাহ করতেন তাঁরা। এদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাজশাহী তথা বাংলাদেশের শান্তি–শৃঙ্খলা বিনষ্ট করা।
র্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্ত থেকে অস্ত্র ঢোকার সময় তা উদ্ধার করার মূল দায়িত্ব বিজিবির। তবে সীমান্তে র্যাব ‘সোর্স’ নিয়োগ করে এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্রসহ কারবারিদের গ্রেপ্তার করছে।
সীমান্তে টহল ও নজরদারি বৃদ্ধি
বিজিবি সূত্র জানায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের অংশে তিন হাজার কিলোমিটারের মতো কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হলেও বাংলাদেশ অংশে তা নেই। বাকি সীমান্ত অরক্ষিত।
বিজিবি সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (জিএস শাখা) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এম এম খায়রুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার বড় একটি উপকরণ হলো সীমান্তে দিয়ে দেশে অস্ত্র ঢোকা।’ তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত। এই সীমান্তের প্রতি ইঞ্চিতে পাহারা বসানো সম্ভব নয়।
অস্ত্রের চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্ত কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়, এমন প্রশ্নে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা সীমান্তে আভিযানিক কার্যক্রম, টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়িয়েছি। উত্তরবঙ্গের রহনপুর সোনা মসজিদ, চুয়াডাঙ্গা, মহেশপুর, কুষ্টিয়া সীমান্ত স্পর্শকাতর বিবেচনায় নিয়ে নজরদারি বেশি বাড়ানো হয়েছে। কারণ, এসব স্থান দিয়ে মানব পাচারও বেশি হয়। তিনি বলেন, বিজিবি মূলত সীমান্ত থেকে দেশের ভেতরের আট কিলোমিটার এলাকার ভেতরে অভিযান চালায়। চোরাচালানিরা যদি কোনোভাবে সীমান্ত দিয়ে দেশের ভেতরে অস্ত্র নিয়ে ঢুকে যায়; সে ক্ষেত্রে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে সমন্বয় করে বিজিবি। যাতে তারা অস্ত্রের চালান আটকাতে পারে।