২১ ট্রমা সেন্টার: শুধু ভবন হয়েছে, নেই চিকিৎসা
২১টি ট্রমা সেন্টারের ১৬টির কোনো কার্যক্রম নেই।
২টির নির্মাণকাজ এখনো চলছে।
২টিতে শুধু বহির্বিভাগ চালু হয়েছে। একটি জেলা হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জরুরি চিকিৎসা দিতে মাদারীপুরের শিবচরের দত্তপাড়ায় নির্মাণ করা হয়েছিল ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ট্রমা সেন্টার। ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১২ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ২০২২ সালের নভেম্বরে ট্রমা সেন্টারটি উদ্বোধন করেন। অবশ্য শুধু উদ্বোধনই হয়েছে, ট্রমা সেন্টার আর চালু হয়নি।
শিবচরের এই ট্রমা সেন্টারের অবস্থান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের (ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে) একদম পাশে। গত রোববার শিবচরে এক্সপ্রেসওয়েতে বাস দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯ জন। আহত হন অন্তত ২৫ জন। আহতদের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও এক্সপ্রেসওয়ের পাশের বেসরকারি একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ট্রমা সেন্টারে নেওয়া হয়নি; কারণ, সেটি চালু হয়নি।
সারা দেশে এমন ২১টি ট্রমা সেন্টার (আহতদের চিকিৎসাকেন্দ্র) নির্মাণ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর ১০টি ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ও ১১টি ২০১০ সালে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন ১৬টিতেই কোনো কার্যক্রম নেই। দুটির নির্মাণকাজ চলছে। দুটিতে শুধু বহির্বিভাগ চালু আছে। একটি সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগ হিসেবে চালু রয়েছে।
মহাসড়কের পাশে ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করার উদ্দেশ্য ছিল, দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত আহতদের সেখানে নিয়ে যাওয়া এবং চিকিৎসা দেওয়া, যাতে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়। জানা গেছে, প্রতিটি ট্রমা সেন্টারে সাতজন পরামর্শক চিকিৎসক (কনসালট্যান্ট), তিনজন অর্থোপেডিকস সার্জন, দুজন অ্যানেসথেটিস্ট (অবেদনবিদ), দুজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন চিকিৎসক, ১০ জন নার্স এবং ফার্মাসিস্ট, রেডিওগ্রাফার, টেকনিশিয়ানসহ ৩৪টি পদ সৃজনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো সেন্টারেই পদ অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরঞ্জামও দেওয়া হয়নি।
সব মিলিয়ে যে উদ্দেশ্যে ট্রমা সেন্টার করা হয়েছে, তা পূরণ হয়নি। এসব ট্রমা সেন্টার নির্মাণে মোট কত টাকা ব্যয় হয়েছে, তা জানাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ট্রমা সেন্টারগুলো নির্মাণে অন্তত ১৪০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
ব্যবহার না থাকায় ট্রমা সেন্টারের অবকাঠামো নষ্ট হচ্ছে। কোথাও কোথাও ভবনের মালামাল চুরি হয়েছে। কিছু ভবন খালি পড়ে থাকায় সেখানে মাদকের আসর বসাচ্ছে মাদকসেবীরা।
নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৪০ কোটি টাকা। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ট্রমা সেন্টার ধারণাটি বাস্তবসম্মত নয়।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) শেখ দাউদ আদনান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ট্রমা সেন্টার ধারণাটি বাস্তবসম্মত নয়। পরিকল্পনাগত দুর্বলতার কারণে ট্রমা সেন্টারগুলো কাজে লাগানো যায়নি। ট্রমা সেন্টার চালানোর মতো জনবল নেই। তিনি বলেন, নতুন করে আর ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করা হবে না। নির্মিত ভবনগুলো কীভাবে লাগানো যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা হচ্ছে।
ট্রমা সেন্টারগুলো নির্মাণ করা হয়েছে পাবনার আটঘরিয়া, বগুড়ার শেরপুর, সিরাজগঞ্জ সদর ও উল্লাপাড়া, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, গোপালগঞ্জ সদর, মাদারীপুরের শিবচর, মানিকগঞ্জের শিবালয়, শরীয়তপুরের জাজিরা, ফরিদপুরের ভাঙ্গা (মধুখালী), মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, সাভারের ধামরাই, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, হাটহাজারী ও রাউজান, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ফেনীর মহিপাল, ময়মনসিংহের ভালুকা, সুনামগঞ্জের ছাতক এবং হবিগঞ্জের বাহুবলে।
‘রাজনৈতিক’ উদ্বোধন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের আশপাশে রয়েছে চারটি ট্রমা সেন্টার। এর মধ্যে মাদারীপুরের শিবচর ট্রমা সেন্টারটিতে ১৫ মার্চ গিয়ে দেখা যায়, সেটি বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নেই ট্রমা সেন্টারে। স্থানীয় কয়েকজন দাবি করেন, সেন্টারটির ভেতরে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে।
ট্রমা সেন্টারটি উদ্বোধনের পরও চালু না থাকার বিষয়ে মাদারীপুরের সিভিল সার্জন মুনীর আহমদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মূলত সেটি ছিল পলিটিক্যাল (রাজনৈতিক) উদ্বোধন। ট্রমা সেন্টার চালু রাখার জন্য জনবল নেই, লজিস্টিক সাপোর্ট (সরঞ্জাম সুবিধা) নেই। তিনি বলেন, ‘শিবচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই ঠিকমতো চিকিৎসক ও নার্স নেই। ট্রমা সেন্টারে কীভাবে জনবল দেব?’
বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের আশপাশে আরেকটি ট্রমা সেন্টার রয়েছে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায়। তিনতলা এই ট্রমা সেন্টারের ভবন নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০২০ সালে। ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেন্টারটির বিভিন্ন কক্ষের ফ্যান, বাতিসহ মালামাল চুরি হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই ভবনও এখন মাদকসেবীদের আড্ডাস্থল।
জানতে চাইলে মুন্সিগঞ্জের সিভিল সার্জন মঞ্জুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ট্রমা সেন্টারটি চালু না হওয়ার কারণ যন্ত্রপাতি ও জনবল না পাওয়া।
বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক ঘিরে বাকি দুই ট্রমা সেন্টারের একটি শরীয়তপুরের জাজিরায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলায় চালুর কথা ছিল। তবে তা হয়নি। ভবনের একাংশ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যটি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস হাসপাতালটির অর্থোপেডিক বিভাগ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভবন পড়ে আছে
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে ভৈরবের কমলপুর এলাকায় ট্রমা সেন্টারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০২০ সালের মার্চে। ব্যয় হয় প্রায় ১৯ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ট্রমা সেন্টারের কার্যক্রম চালু হয়নি। তবে গত ২০ ফেব্রুয়ারি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ স্থানীয় উদ্যোগে সেখানে বহির্বিভাগ চালু করেছে।
ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ট্রমা সেন্টারটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক লাগোয়া। এই মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে। রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিতে সেন্টারটি খুবই প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, ট্রমা সেন্টারটি চালুর জন্য কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম মহাসড়ক বরাবরই দুর্ঘটনাপ্রবণ। দুর্ঘটনায় আহতদের জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের মুলিবাড়ীতে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা ট্রমা সেন্টার। ২০২০ সালে এটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা। সিরাজগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রেও ঘটনা একই। জনবল ও সরঞ্জামের অভাবে সেন্টারটি চালু করা যায়নি।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে হবিগঞ্জের বাহুবলে নির্মিত ট্রমা সেন্টারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৩ সালে। ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ট্রমা সেন্টার খালি পড়ে আছে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে উদ্বোধনের পরও চালু হয়নি ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পাশে শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে নির্মিত ট্রমা সেন্টার। এটির নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোনাপাড়া এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে চারতলা ভবনের ট্রমা সেন্টারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। ব্যয় হয় প্রায় ১২ কোটি টাকা। তবে জনবল দেওয়া হয়নি। জেলার সিভিল সার্জন নিয়াজ মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, চালুর আগেই ৮ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বাকি পড়েছে। তাই বিদ্যুৎ বিভাগ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার শহীদনগরে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ট্রমা সেন্টারটিও বন্ধ রয়েছে। এটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০৬ সালে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা হয় একটি ট্রমা সেন্টার। সেখানে এখন পর্যন্ত কোনো জনবল নিয়োগ ও সরঞ্জাম দেওয়া হয়নি। নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা সদরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চারতলা ট্রমা সেন্টার ভবনের নির্মাণকাজ শেষে হস্তান্তর করা হয় ২০১৫ সালে। তবে এখানেও জনবল ও সরঞ্জাম দেওয়া হয়নি। ভবন নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল দেড় কোটি টাকা। ধামরাইয়ে প্রায় ১১ বছরে একটি ট্রমা সেন্টার ভবন নির্মাণ শেষ হয়। এখনো সেন্টারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।
ময়মনসিংহের ভালুকা ট্রমা সেন্টারটিতে ছয় মাস আগে শুধু বহির্বিভাগ চালু হয়েছে। রোগী ভর্তির কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানে চারজন চিকিৎসক রয়েছেন।
সরকার আর ট্রমা সেন্টার প্রতিষ্ঠা না করার সিদ্ধান্ত নিলেও দুটির নির্মাণকাজ এখন চলছে। একটি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায়, ব্যয় ১৩ কোটি টাকার বেশি। অন্যটি চট্টগ্রামের রাউজানে, ব্যয় প্রায় ১২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্মাণ শেষে চিকিৎসক ও সরঞ্জাম দেওয়া না হলে নতুন দুই ট্রমা সেন্টারের পরিণতি আগেরগুলোর মতো হবে।
জনগণের অর্থ ‘অপচয়’
ট্রমা সেন্টারের ভবনগুলো খালি পড়ে থাকার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং তাতে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে সড়কে প্রাণ গেছে ৭ হাজার ৭১৩ জনের।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ভবন বা স্থাপনা নির্মাণে সরকারি সংস্থার আগ্রহ থাকে। কিন্তু সেই স্থাপনা বা ভবন ব্যবহার করে মানুষকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগ থাকে না। নির্মাণে আগ্রহের কারণে সেখানে কেনাকাটা ও ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার বিপরীতে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার সুযোগ থাকে।
জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকায় ট্রমা সেন্টারের মতো প্রকল্প নেওয়া হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জবাবদিহি থাকলে জনগণের অর্থের অপচয় করে এমন প্রকল্প কেউ নিতে পারত না। প্রকল্প নেওয়ার আগে কোথায় কত দুর্ঘটনা ঘটে, কত রোগী আসে, কত জনবল দরকার—এসব বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দরকার ছিল।
এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ট্রমা সেন্টারের দরকার আছে। জনবল নিয়োগ ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে সেগুলো চালু করা সম্ভব।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]