মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞায় কেউ হবেন মুক্তিযোদ্ধা, কেউ সহযোগী

সাধারণ পোশাক পরিহিত মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বাহিনীছবি: মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র বই থেকে

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং যাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, শুধু তাঁরাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি পাবেন। এর বাইরে যাঁরা দেশে-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, বিশ্বজনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁরা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন করে নতুন যে অধ্যাদেশ হতে যাচ্ছে, তাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০২২ সালে। সর্বশেষ সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন এবং যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের সবাইকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা পরিবর্তন আনার দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এরপর বিষয়টি নিয়ে তাঁরা খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এবং বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রায় সবাই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন আর যাঁরা বিভিন্ন উপায়ে অবদান রেখেছেন, তাঁরা একই কাতারে থাকতে পারেন না। যে কারণে সবার মতামত নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে।

তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একাধিক গবেষক প্রথম আলোকে বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন করেছিল। এখন আবার নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শ্রেণি করাও ঠিক হচ্ছে না। এটি সম্মানজনক হবে না। ভবিষ্যতে এ নিয়ে সংকট ও তিক্ততা আরও বাড়বে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো সুবিধার কারণে এসব পরিবর্তন হয়। মুক্তিযুদ্ধে নানা ধরনের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, বিভিন্নভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক কারণে সব সরকারই মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। এটি এখন আবার হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কারা হবেন

খসড়া অধ্যাদেশে নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল–বদর, আল শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এ রূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাঁদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল) বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। এর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, বিএলএফ ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট (ইপিআর), নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স ও আনসার সদস্যরাও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।

সংজ্ঞায় বেসামরিক নাগরিক বলতে তিনটি শ্রেণির কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীর মাধ্যমে নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা)। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারী। এই তিন শ্রেণির সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন।

কারা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী

খসড়া অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী নামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। সহযোগীদের সম্পর্কে বলা আছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাঁরা দেশের ভেতরে বা প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর মর্যাদা পাবেন।

সহযোগীদের জন্য পাঁচটি শ্রেণি ঠিক করা হয়েছে। প্রথমত, যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত, মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) বা এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য), যাঁরা পরবর্তী সময়ে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। চতুর্থত, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক। পঞ্চমত, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

যদিও এই পাঁচ শ্রেণির ব্যক্তিরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছেন। জামুকা আইনের সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি হলে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হবেন।

বিদ্যমান জামুকা আইনে যেসব জায়গায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা রয়েছে, অধ্যাদেশে তা বাদ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দের পরিবর্তে ‘লক্ষ্য’ শব্দটি যুক্ত করা হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধ বলতে জামুকা আইনে এখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। নতুন অধ্যাদেশে এই লাইনসহ কিছু শব্দ বাদ পড়ছে। এর পরিবর্তে লেখা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আল–বদর, আল–শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১ বার বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলানো হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে পাঁচবার। অধ্যাদেশ জারি হলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলাবে ১২ বার। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে সাতবার।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা, ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য তথ্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামের একটি সফটওয়্যারে হালনাগাদ করে থাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এমআইএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। তবে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করা হলে স্বাভাবিকভাবেই বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে যাবে। সেটি কমে কত হবে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম ২৩ মার্চ তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত যাঁরা রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কেবল তাঁরাই বীর মু্ক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। যাঁরা নানা আঙিকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কেউ কূটনৈতিক সহযোগিতা করেছেন, কেউ গান গেয়েছেন, তাঁরা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।’

ফারুক–ই–আজম বলেন, জামুকার সংশোধিত অধ্যাদেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। তারা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, সেগুলো সংশোধন করা হচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারে (মুজিবনগর সরকার) যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। খসড়া অধ্যাদেশে প্রথমে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করার চিন্তা ছিল। এখন এটি সংশোধন করা হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

খসড়া অধ্যাদেশে নতুন একটি ধারা (১৪) যুক্ত করা হয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ অর্থ ‘১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের পক্ষে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে যে চেতনা’।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের পর কোনো বিতর্কের বিষয় ছিল না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার আদি রূপে ফেরার একটা প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার পরিধি যেভাবে বাড়িয়েছিল, তাতে প্রবাসীরাও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাওয়া শুরু করেছিলেন। এর রাশ টেনে ধরতে চাইছে এই সরকার।

গবেষক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের যেভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগের সরকার নিয়েছিল, তা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু এবার যেভাবে তাঁদের সহযোগীর কাতারে নামিয়ে আনা হচ্ছে, তাতে বিতর্ক আরও বাড়বে। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলা হয়, তাই নানা ধরনের সহযোগীদের আলাদা করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টা সুবিবেচনা প্রসূত হবে না।