হোলি আর্টিজানে হামলার ৭ বছর
দুর্বিষহ রাত আর বীভৎস সকাল
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে সাত বছর আগে এই দিনে নৃশংস জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান দেশি-বিদেশিসহ ২০ জন। সেই হামলা নিয়ে ২০১৭ সালের ১ জুলাই প্রকাশিত ‘দুর্বিষহ রাত আর বীভৎস সকাল’ প্রতিবেদনটি আবার প্রকাশ করা হলো
জঙ্গিরা ‘বড় কিছু’র পরিকল্পনা করছে, এমন কথা বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে থেকে সেই সব তথ্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে কিছু প্রতিবেদনও হয়েছে। কিন্তু কখনো ভাবনায় আসেনি এমনটি হতে পারে, যা হয়েছে গুলশানের হোলি আর্টিজানে।
রোজার মাস। শুক্রবার। কাজ শেষে অফিস থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই রাত সাড়ে নয়টার দিকে এক সহকর্মীর ফোন। বললেন, ‘গুলশানে নাকি গোলাগুলি হচ্ছে, তুমি কিছু জানো?’ এর মধ্যেই আরেকজনের ফোন। বললেন, গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসীরা ঢুকেছে, গোলাগুলিও হয়েছে। ভাবলাম সামনে ঈদ, চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা হতে পারে। আবার ভাবনায় এল, নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা গুলশানের ওই কূটনৈতিক পাড়ায় গোলাগুলির ঘটনা সাধারণ কিছু নয়। এমন অনেক ভাবনা কাজ করছিল। ঘটনা সম্পর্কে জানতে গুলশানের দু-একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন দিয়েও পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ গুলশান থানার একজনকে ফোনে পেলাম। বললেন, ৭৯ নম্বরের দিকে রেস্তোরাঁয় হামলা হয়েছে, বড় ঘটনা। এরপরই ব্যস্ত পুলিশ কর্মকর্তা ফোন রেখে দিলেন। শুনেই গুলশানের পথ ধরলাম।
ঘটনাস্থলমুখী গুলশানের অনেক পথ বন্ধ করে চৌকি বসানো হয়েছে। চৌকিগুলোতে আটকে পড়া মানুষের ভিড়। কয়েকটি চৌকি পেরিয়ে রাত প্রায় ১০টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে পৌঁছালাম, ঘটনাস্থল থেকে শ দুয়েক গজ দূরে। ততক্ষণে রেস্তোরাঁটির চারপাশে পুলিশ আর র্যাবের বিপুল সদস্য অবস্থান নিয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে জানা গেল, রেস্তোরাঁটির নাম হোলি আর্টিজান বেকারি। ভেতরে বেশ কয়েকজন বিদেশিসহ বহু লোককে জিম্মি করেছে একদল অস্ত্রধারী। গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়েছে।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে কথা হয় হোলি আর্টিজান থেকে পালিয়ে বের হওয়া কর্মী সুমন রেজার সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে ভেতরের তথ্য জানার চেষ্টা চলছিল কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর। সুমনই প্রথম জানালেন, সন্ত্রাসীরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ধ্বনি দিচ্ছিল। এ সময় সামনে দিয়েই পুলিশ ও র্যাবের একটি যৌথ দল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও দাঙ্গা দমনের সরঞ্জাম পরে বেকারিটির দিকে গেল।
খবর এল, পরিচিত অনেক পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি। ওই হাসপাতালে তখন বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। গোয়েন্দা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার রবিউল করিমের মৃত্যুর খবরটা আগে এল। একটু পরে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খানের মৃত্যুর খবরটা দিলেন পুলিশের একজন গাড়িচালক। মনটা আরও ভেঙে গেল।
এর মধ্যে ভেতরে আটকে পড়াদের কয়েকজন স্বজন ঘটনাস্থলে এসেছেন। তাঁরা আকুল হয়ে জানতে চাইছেন ভেতরে আসলে কী হচ্ছে, কেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের জিম্মি করা হয়েছে? জিম্মিকারীরা কী চায়? কিন্তু সবাই নিরুত্তর। ভেতরে কী চলছে তার খবর তখনো জানে না কেউ।
জিম্মিদের স্বজনদের অপেক্ষা, মুঠোফোনে অন্য স্বজনদের সঙ্গে তাঁদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হচ্ছিল। তাঁদের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর ঘটনাস্থলে আসছে। ভেতরে কোন কোন দেশের নাগরিকেরা রয়েছেন, তাঁরা জীবিত কি না, সন্ত্রাসীরা কোন গোষ্ঠীর ইত্যাদি প্রশ্ন ঘুরেফিরে সবার মুখে। বাড়তে থাকে স্বজনদের ব্যাকুলতা। পুলিশ-র্যাবের কর্মকর্তাদের কাছে তাঁদের প্রশ্ন, কেন সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে না বা জিম্মিদের ছাড়াতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না?
হোলি আর্টিজান থেকে খুব বেশি হলে দুই-আড়াই শ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বজনেরা। ৭৫ নম্বর সড়কের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের পরিচালক সিমিন হোসেন ও তাঁর বড় ছেলে যারেফ আয়াত হোসেন। সঙ্গে আরও কয়েকজন আত্মীয় ও সহকর্মী। সবাই খুব উদ্বিগ্ন। সিমিনের ছোট ছেলে ফারাজ আইয়াজ হোসেন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে বেকারিতে আটকা। ফারাজের সঙ্গে ছিলেন তাঁর ভারতীয় বন্ধু তারিশি জৈন। রাস্তায় তারিশির মা-বাবাও ছিলেন।
তিতুমীর কলেজের বিএর শিক্ষার্থী গোপাল জানালেন, হোলি আর্টিজানে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেন তাঁর বড় ভাই সমীর বাড়ৈ। ভাগনে রিন্টু কীর্তনিয়া (১৬) একই বেকারিতে কাজ করে। ভাইয়ের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ হয়েছে। তিনি বেকারির ভেতরে একটি টয়লেটে আরও কয়েকজনের সঙ্গে আটকা পড়েছেন।
ঘটনাস্থলের সর্বশেষ তথ্য সঙ্গে সঙ্গেই অফিসে ফোনে জানাতে হচ্ছিল। অফিসে সহকর্মীরাও রাতজাগা। এদিকে মুঠোফোনের চার্জও ফুরিয়ে আসছে।
পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বসেছেন রাস্তার উল্টো দিকে বিজেএমসির চেয়ারম্যানের বাংলোতে। পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছু কথা হচ্ছে। তাঁরা তখন ওই রেস্তোরাঁ থেকে পালিয়ে বের হওয়া কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। ওই কর্মীদের কাছ থেকে ভেতরে কতজন আছে, তাদের কাছে কী অস্ত্র আছে, বেকারিটির ভেতরের রূপরেখা কেমন, ঢোকার ও বের হওয়ার পথ কয়টি ইত্যাদি খুঁটিনাটি তথ্য জেনে অভিযানের জন্য মানচিত্র তৈরির চেষ্টা চলছিল।
রাত দুইটার পরে ভেতরে হত্যাযজ্ঞের খবর শোনা যায়। খবরের উৎস যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের কর্ণধার রিটা কাৎজের টুইট। রিটা জঙ্গি সংগঠন আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা আমাকের বরাত দিয়ে জানাচ্ছেন, সেখানে হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। সঙ্গে হত্যাযজ্ঞের তিনটি ছবি।
শেষ রাতের দিকে এক কর্মকর্তা বললেন, অভিযান চালাবে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা। তারা সিলেট থেকে আসছে।
সকাল সাতটার দিকে সেনাবাহিনীর কমান্ডো ফোর্সকে জিম্মি এলাকায় মোতায়েন করা হয়। ১১ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা শেষে ৭টা ৪০ মিনিটে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। সাঁজোয়া যান নিয়ে দেয়াল গুঁড়িয়ে বেকারির ভেতরে ঢুকে পড়েন সেনা কমান্ডোরা। শুরু হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গুলশান এলাকা। ১৩ মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। ৫০ মিনিট পর অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
সকালে অভিযান শেষে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক চলে যাওয়ার সময় তাঁর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যান তারিশি জৈনের মা। তিনি আইজিপির কাছে জানতে চান, তাঁর সন্তান বেঁচে আছে কি না। এর কয়েক ঘণ্টা পরই বেলা সোয়া তিনটার দিকে তারিশিসহ অন্যদের লাশ নিয়ে ভেতর থেকে বের হতে শুরু করে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স।