মনে হচ্ছিল যেন সম্মুখযুদ্ধের ময়দান। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে দুই পক্ষ। একদিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ, অন্যদিকে খালি হাতে সাধারণ ছাত্র-জনতা। তাঁদের কারও কারও হাতে আছে চ্যালা কাঠ আর ইটের টুকরা। পুলিশ তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছিল। লাশ পড়ছিল একের পর এক। আহত হচ্ছিলেন অনেকে। পথে বয়ে যাচ্ছে রক্তের স্রোত।
দৃশ্যটি কোনো যুদ্ধ বা সিনেমার নয়, বাস্তব ঘটনা। এ দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে গত ৫ আগস্ট সাভার থেকে। সেদিন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকা হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সাভার থেকে ছাত্র–জনতা রাজপথে সমবেত হতে থাকেন সকাল থেকেই। তাঁরা ঢাকার দিকে যাত্রা করলে সাভার বাসস্ট্যান্ডের সামনে পুলিশ বাধা দেয়। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। চলতে থাকে গোলাগুলি আর ইটপাটকেল নিক্ষেপ।
একপর্যায়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় তখন বিজয়ী ছাত্র-জনতার আনন্দোল্লাসের বাঁধভাঙা জোয়ার; কিন্তু ঢাকার অদূরে সাভারের পরিস্থিতি ছিল একেবারে ভিন্ন। ছাত্র-জনতার সঙ্গে সেখানে পুলিশের সংঘর্ষ, গোলাগুলি চলছিল। এ ঘটনা প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে। শেখ হাসিনার পতনের পরের ছয় ঘণ্টায় সাভারে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৫ জন প্রাণ হারান। গুলিতে মারাত্মক আহত হন ৩৩ জন।
এ ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোর ভিডিও বিভাগ তৈরি করেছে সাভার হত্যাকাণ্ড: হাসিনা পালানোর পরের ৬ ঘণ্টা নামের প্রামাণ্যচিত্র। এটি নির্মাণ করেছেন ভিডিও বিভাগের জ্যেষ্ঠ কনটেন্ট ক্রিয়েটর আব্দুল্লাহ আল হোসাইন। বুধবার প্রামাণ্যচিত্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় চলমান ‘জুলাই-জাগরণ’ প্রদর্শনীতে। এ অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন এবং প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
সারা হোসেন প্রদর্শনী ও প্রামাণ্যচিত্র দেখে বলেন, ‘এই ছবি ও দৃশ্যগুলো যতবার দেখি, গভীর বেদনাবোধ করি। কী করে এই মর্মান্তিক গণহত্যার ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করা যায়! কিন্তু এখনো একটি পক্ষ বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে, এমন ঘটনা ঘটেনি। এমনকি অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিও এমন কথা বলছেন। এটা বিস্ময়কর। তাহলে কি যাঁরা গুলিতে মারা গেলেন, আহত হলেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের হতাহত করেছেন?’
সারা হোসেন বলেন, এসব হত্যার বিচার দাবি করছেন হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো। অবশ্যই বিচার পেতে হবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো বিচার পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। গত ৫০ বছরে এমন বহু ঘটনা রয়েছে, যার বিচার হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু বিচার হয়নি। এর একটি বড় কারণ বিচারের জন্য উপযুক্ত সাক্ষ্য–প্রমাণ না থাকা। মানুষ ভয়ভীতির মধ্যে থাকেন। আদালতে সত্য কথাটি বলতে পারেন না। বলতে দেওয়া হয় না। প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয় না। এ অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে।
বিচারের জন্য প্রথম আলোর এই প্রামাণ্যচিত্র, এই প্রদর্শনী ভূমিকা রাখতে পারে বলে উল্লেখ করে সারা হোসেন বলেন, প্রথম আলো তার অবস্থান থেকে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করছে।
সাজ্জাদ শরিফ বলেন, রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বরং তাদের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড চাপিয়ে দিয়েছে। যারা সরকারের বিরোধিতা করেছে, তাদের গুম করেছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতি কতটা নিষ্ঠুরতা করেছে, বিমানবিকীকরণের মধ্য দিয়ে কেমন করে এই গণহত্যা চালিয়েছে, এই প্রামাণ্যচিত্র তার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা আব্দুল্লাহ আল হোসাইন বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পরে সাভার, সায়েদাবাদ, মোহাম্মদপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। সাভারে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সেলফোনে তোলা প্রায় ৪০০ ভিডিও–দৃশ্য থেকে এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। সাভারের পাঁচটি জায়গায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটেছিল। সেই স্থানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্তত ১৫ শহীদের নাম–পরিচয় পাওয়া গেছে।
এই ১৫ শহীদের নাম—মো. হাসিবুর রহমান, মো. সাজ্জাদ, মো. আবদুল কাইয়ুম, মো. সুজন মিয়া, আলিফ আহমেদ সিয়াম, শ্রাবণ গাজী, মুজাহিদ মল্লিক, নাফিসা হোসেন মারওয়া, আল আমিন, সাফওয়ান আক্তার, মো. রফিক, নিশান খান, তানজীর খান মুন্না, মো. মিঠু ও আবদুল আহাদ।
প্রদর্শনী দেখতে গতকালও অনেকে এসেছিলেন। মোহাম্মদপুর থেকে আসা গৃহবধূ পারভিন সুলতানা প্রামাণ্যচিত্র দেখে বলেন, এভাবে সরাসরি গুলি করে মানুষ মেরেছে ভাবাই যায় না। এই প্রামাণ্যচিত্র সাভার গণহত্যার দলিল হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে বিচারে কাজে আসবে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথমা প্রকাশনের মেরিনা ইয়াসমিন।
প্রথম আলোর আয়োজনে জুলাই অভ্যুত্থানের ছবি, শহীদদের ব্যবহৃত সামগ্রী, প্রথম আলো পত্রিকার বিভিন্ন সংবাদ–নিবন্ধসহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে ২৪ জানুয়ারি শুরু হয়েছে জুলাই-জাগরণ প্রদর্শনী। প্রদর্শনী চলবে আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত।