সাংবাদিক গোলাম রব্বানি হত্যার বিচার দাবি বিভিন্ন দল–সংগঠনের
সংবাদ প্রকাশের জেরে জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার ও সাংবাদিকদের সংগঠন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ), গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি বিবৃতি দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছে।
বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক ও মহাসচিব দীপ আজাদ এবং ডিইউজের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে গোলাম রব্বানি নাদিম হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তাঁরা।
সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আগামীকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএফইউজে ও ডিইউজে। সংগঠন দুটির নেতারা বলেছেন, সন্ত্রাসী হামলায় একের পর এক সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে। সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনায় সন্ত্রাসীদের ঔদ্ধত্য ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অবিলম্বে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।
বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকনও আজ এক বিবৃতিতে দ্রুত হত্যাকারী ও নির্দেশদাতাদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, একের পর এক কালাকানুন ছাড়া সাংবাদিক হেনস্তা, নিপীড়ন, খুন, গুম ও হুমকির মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার নামান্তর; একই সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রধান অন্তরায়। এর আগে বিভিন্ন সময় সাংবাদিক হেনস্তা, নিপীড়ন, খুন ও হুমকির বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
টিআইবি ও এমএসএফের বিবৃতি
টিআইবি এ ঘটনাকে মুক্ত সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হতাশাজনক ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটি বিবৃতিতে বলেছে, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার জেরে সাংবাদিকদের ওপর অবারিতভাবে চলমান হামলা, মামলা, নির্যাতন ও হত্যা বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এমন ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষমতার আনুকূল্যে বিচারহীনতা ভোগ করাও স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুর হত্যার সর্বশেষ শিকার গোলাম রব্বানি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারের সদিচ্ছার উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
টিআইবি বিবৃতিতে আরও বলেছে, সংবাদ প্রকাশের জেরে বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের একজন জনপ্রতিনিধি সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন। চেয়ারম্যানের লোকজনই পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর ফেরার পথে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন গোলাম রব্বানিকে। শুধু তা–ই নয়, গত ১১ এপ্রিল গোলাম রব্বানিকে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতাও মারধর করেছিলেন বলে বিভিন্ন সংবাদে জানা যায়।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের জেরে গোলাম রব্বানি হত্যাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায় নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেই সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবান ও তাঁদের যোগসাজশে সাংবাদিকের ওপর হামলা, নির্যাতন, আটক, গুম, এমনকি হত্যা এখন নিয়মিত হয়ে উঠেছে। এ হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতাধরেরা নিজেদের দুর্নীতি-অন্যায় লুকিয়ে রাখতে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। সুষ্ঠু তদন্ত করে এ হত্যায় সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের পাশাপাশি যাঁদের নির্দেশ, যোগসাজশে ও যাঁদের স্বার্থ সুরক্ষায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।’
এমএসএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত করা হয়েছে। এটি শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতারও পরিপন্থী। সাংবাদিক গোলাম রব্বানির মৃত্যু মারাত্মকভাবে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের মধ্যে ভয় ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সাংবাদিক গোলাম রব্বানির মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে গ্রেপ্তার করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে এমএসএফ।
গণসংহতি আন্দোলন–বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির বিবৃতি
সাংবাদিক রব্বানি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল। আজ এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, নাগরিক অধিকার থেকে শুরু করে আজ সংবাদমাধ্যমের গলা টিপে ধরে সরকার জনগণকে এটাই বারবার জানান দিচ্ছে, সরকারের লুটপাট, দুর্নীতি, দুঃশাসন নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। দেশে কোনো জবাবদিহি থাকবে না। সরকারের সমালোচনা চলবে না।
এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আজ এক বিবৃতিতে বলেছেন, দেশে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এখন প্রবল ঝুঁকির মধ্যে। জবাবদিহিহীন নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থায় পেশাদার সাংবাদিকতাকে অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে অধিকাংশ সাংবাদিক নিপীড়ন ও তাঁদের হত্যার বিচার হয়নি। সে কারণে ক্ষমতাবানেরা বেপরোয়া। তাদের হাত এতটাই লম্বা যে প্রচলিত আইন–আদালত তাদের স্পর্শ করতে পারে না।
গত বুধবার রাত ১০টার দিকে বাড়িতে ফেরার পথে জামালপুরের বকশীগঞ্জের পাটহাটি মোড়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন সাংবাদিক গোলাম রব্বানি। এ সময় তাঁকে ব্যাপক মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তাঁকে ফেলে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতেই তাঁকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেও অবস্থার অবনতি হলে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়।
গোলাম রব্বানি বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি ছিলেন। একই সঙ্গে একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা সংবাদ সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করতেন।