সংবিধান সংশোধনের রাজনীতি—১
সংবিধানের দাবি থেকে স্বাধীনতা
প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। গত ৫০ বছরে এ সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন শুধু ‘তাত্ত্বিক’ বিষয় নয়, সব সময় এর একটি প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য থাকে। সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের গত পাঁচ দশকের ইতিহাস থেকে দেখে যায়, বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনেরা একদিকে যেমন সংবিধান রক্ষার ‘হাঁকডাক’ দিয়েছেন, তেমনি নিজেদের স্বার্থে বা ক্ষমতা ‘কুক্ষিগত’ করতে সংবিধানে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন এনেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সংকট, যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা, সামরিক শাসন, সরকারগুলোর কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা—এ সবকিছুই সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে আট পর্বের এই লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রতি রোববার প্রকাশিত হবে। আজ প্রথম পর্ব।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। সেই হিসাবে সংবিধান একটি মাইলফলক অতিক্রম করেছে। সংবিধানকে বলা হয় প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। এতে সাধারণত সরকারের গঠনপ্রণালি, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনাসংক্রান্ত নীতিমালা এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়। এর ফলে রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা প্রবণতা, বাঁক বদল কিংবা পরিবর্তনের সঙ্গে সংবিধানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে।
১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানকে তাই অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি লিখিত ও মূর্ত রূপ হিসেবে দাবি করে থাকেন। কিন্তু বাহাত্তরের সেই সংবিধান খুব বেশি দিন অপরিবর্তনীয় ছিল না। বিভিন্ন সরকারের আমলে নানা প্রেক্ষাপটে সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে ‘কাটাছেঁড়া’ করা হয়েছে। এতে সংবিধানের মূল কাঠামোরও পরিবর্তন হয়। সংবিধানের এই পরিবর্তনগুলো কতটা জনগণ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আর কতটা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য আন্দোলন
ভারতবর্ষের অন্তর্গত তৎকালীন বাংলায় প্রায় ২০০ বছরের (১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭) ব্রিটিশ শাসন ছিল খুবই ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত ১০০ বছর শাসন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়া এক ঘোষণায় ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীন করেন, যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ১৮৫৮ সালের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত-সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাক্ট ও আইনের (ভারত শাসন আইন ১৮৬১, ১৮৯২, ১৯০৯, ১৯১৯ ও ১৯৩৫) মাধ্যমে এ অঞ্চলে শাসনতান্ত্রিক বিকাশ ঘটে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের ফলে পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, যার নতুন নাম দেওয়া হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনের ব্যাপক অনুপস্থিতি ছিল। সংবিধান প্রণয়নের ব্যর্থতার কারণে নতুন রাষ্ট্র গঠনের ৯ বছর পর্যন্ত পাকিস্তান ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হলেও এর কার্যকারিতা ছিল মাত্র ২ বছর ৬ মাসের মতো। ১৯৬২ সালে সেনাশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের নির্দেশে আরেকটি সংবিধান তৈরি করা হয়। এর দ্বারা গণতান্ত্রিক শাসনের পরিবর্তে সেনা-আমলা কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য আন্দোলন তাই চলমান ছিল।
’৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা কর্মসূচি এবং ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে সত্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। এই নির্বাচনের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল, নতুন গণপরিষদ ও সংবিধান তৈরি করা। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ’৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের শুরুতেই এবং একাধিকবার সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সত্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এ কারণে ‘সংবিধানের দাবি থেকে স্বাধীনতা’ কথাটা অত্যুক্তি নয়।
অস্থায়ী সংবিধান আদেশ
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ‘সাংবিধানিক ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি হয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরদিন ১১ জানুয়ারি তিনি একটি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এই আদেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে ওয়েস্টমিনস্টার ধরনের সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অস্থায়ী সংবিধান আদেশবলে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
গণপরিষদ বিতর্ক ও সংবিধান প্রণয়ন
অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অস্থায়ী সংবিধান আদেশে আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে একটি গণপরিষদ গঠিত হবে। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন। এই আদেশ অনুসারে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৩০ জন সদস্যকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয় (নানা কারণে ১৯৭২ সালের অক্টোবরে গণপরিষদের সদস্যসংখ্যা ৪০৪ জনে নেমে এসেছিল)।
তাঁদের মধ্যে তিনজন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ-দলীয়। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনের দ্বিতীয় ও শেষ দিন ১১ এপ্রিল ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। তৎকালীন আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে এ কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়।
কমিটিকে ১৯৭২ সালের ১০ জুনের মধ্যে খসড়া সংবিধান জমা দেওয়ার কথা বলা হলেও ১১ অক্টোবর কমিটির শেষ বৈঠকে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন। এরপর নিয়ম অনুযায়ী প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ও চূড়ান্ত পাঠ শেষে ৪ নভেম্বর সংবিধানসংক্রান্ত বিলটি গণপরিষদে গৃহীত হয়। ওই দিন গণপরিষদে দেওয়া সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘...কেবল শাসনতন্ত্র পাস করলেই দেশের মুক্তি হয় না, আইন পাস করলেই দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয় না–ভবিষ্যৎ বংশধর, ভবিষ্যৎ জনসাধারণ কেমন করে কীভাবে শাসনতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে, তারই ওপর নির্ভর করে শাসনতন্ত্রের সাকসেস, কার্যকারিতা।…’
’৭২-এর সংবিধান
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। এই সংবিধানে চারটি তফসিলসহ ১১টি ভাগ ও একটি প্রস্তাবনা ছিল। প্রথম ভাগে প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি, তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার, চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগের প্রকৃতি, পঞ্চম ভাগে আইনসভা (সংসদ), ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগ, সপ্তম ভাগে নির্বাচন, অষ্টম ভাগে মহাহিসাব নিরীক্ষক, নবম ভাগে বাংলাদেশের কর্ম বিভাগ, দশম ভাগে সংবিধান সংশোধন এবং একাদশ ভাগে বিবিধ বিষয় সম্পর্কে বলা হয়।
’৭২-এর সংবিধান ছিল এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সংবিধান। এর একটি অনুমোদিত ইংরেজি অনুবাদও রয়েছে। সংবিধান ও এর ভাষা নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সংবিধান: পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমাদের সংবিধানের শব্দ, বাক্যাংশ এবং ধারণাগুলো অন্যান্য দেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল থেকে প্রবলভাবে ধার করা। আমাদের সংবিধানের দুটি পাঠ রয়েছে। ১৫৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্ভরযোগ্য বাংলা পাঠ এবং অনুমোদিত ইংরেজি পাঠের মধ্যে বাংলা পাঠই প্রাধান্য পাবে। এটাই হওয়া উচিত ছিল।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষাই ছিল মূল আসঞ্জনী শক্তি। এক অর্থে জাতীয় আন্দোলন শুরুই হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। প্রথমবারের মতো বাংলায় সংবিধান রচনা ছিল আমাদের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। আধুনিক সাংবিধানিক ধারণাগুলোকে আমাদের আইনি সংস্কৃতির মধ্যে আত্তীকৃত করার ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিরাট পদক্ষেপ।’
সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনারও মূলনীতি হিসেবে বলা হয়। সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে রাষ্ট্রকে নাগরিকের প্রতি বৈষম্য না দেখাতে বলেছে। এ ছাড়া চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতা, পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ’৭২ সালের সংবিধানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রথমটি হলো, নিবর্তনমূলক আটকাদেশের অনুপস্থিতি। দ্বিতীয়টি হলো, জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও মৌলিক অধিকার স্থগিতকরণ-সংক্রান্ত বিধানের অনুপস্থিতি।
’৭২-এর সংবিধান নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশ পলিটিকস: প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুস বইয়ে রওনক জাহান লিখেছেন, কিছু পরিবর্তন ও সংশোধনের সুপারিশসহ ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ও কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ) সংবিধানকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে ন্যাপ (ভাসানী) ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) আরও জোরালো বিরোধী দল হিসেবে সংবিধানের ওপর গণভোটের দাবি করেছিল। যদিও তারা সম্মত হয়েছিল যে একেবারে কোনো সংবিধান না থাকার চেয়ে একটি খারাপ সংবিধান থাকাও ভালো। সংবিধান যখন সামান্য উত্তপ্ত বিরোধিতার জন্ম দিয়েছে, এটা তরুণদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে অনুপ্রাণিত করতেও ব্যর্থ হয়েছে, যাঁরা সংবিধানে আরও কিছু মৌলিক বিধান (র্যাডিক্যাল প্রভিশন) দেখতে চেয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলের আইনি কাঠামো, বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রায় সব বিধিবিধান বাংলাদেশে সংবিধানে বহাল রাখা হয়। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দমনমূলক আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠানকে বাতিল বা সংস্কার করার বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই এটা ছিল একটা দুর্বলতা।
সংবিধান সংশোধন
১৯৭২ সালে প্রণীত হওয়ার পর বাংলাদেশের সংবিধান এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন হয়েছে। প্রথম থেকে চতুর্থ সংশোধনী আনা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ আমলে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয় যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতায় থাকাকালে।
সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম সংশোধনী আনা হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময়ে। একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের দুই আমলে। পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ সংশোধনী আনা হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ আমলে।
সংবিধান সংশোধন শুধু তাত্ত্বিক বিষয় নয়। সব সময়ই এর একটি প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য থাকে এবং এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলেও সেটি স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের অভাব, সামরিক শাসন, নেতৃত্বের ক্ষমতালিপ্সা, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা—এ সবকিছুই সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক