২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

দেশে সাড়ে ৪ বছরে ৭৯১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার

সিরডাপ মিলনায়তনে আজ সোমবার এইচআরএফবির আয়োজনে জাতীয় পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়
ছবি: প্রথম আলো

দেশে গত সাড়ে চার বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ৭৯১টি। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে (বন্দুকযুদ্ধ) নিহত হওয়ার ঘটনাই ৬৮৩টি।

একই সময়ে ৪৩ জনকে গুলি করে হত্যা, ৪৪ জনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আর ২১ জন নিহত হয়েছেন পুলিশ হেফাজতে। এ ছাড়া ৫৬ জন গুম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৭ জন এখনো নিখোঁজ ও ২৯ জনকে আটক দেখানো হয়েছে, মুক্তি পেয়েছেন ১০ জন।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আজ সোমবার ২০টি মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) আয়োজিত জাতীয় পরামর্শ সভায় এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১০টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এসব তথ্য সংকলন করেছে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) বা সর্বজনীন পুনর্বীক্ষণ পদ্ধতিতে প্রণয়ন করা খসড়া প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করার লক্ষ্যে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

পরামর্শ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ৭৯১ জনের তালিকা সরকারকে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, গুমের ২৮টি অভিযোগ খতিয়ে দেখছে সরকার। সরকারের কাছে জাতিসংঘের দেওয়া ৭৮ জনের তালিকার মধ্যে ১০ জনের পরিবার পুলিশকে সহায়তা করছে না, আর ১০ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে।

পরামর্শ সভায় আসকের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান সভাপতিত্ব করেন। খসড়া প্রতিবেদন ও বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন এইচআরএফবির সমন্বয়কারী তামান্না হক।

সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা কমেছে, এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে কমে এসেছে বলছি, শেষ হয়ে গেছে তা কিন্তু কেউ বলছে না।’ র‌্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে সংখ্যাটি কমল, তা আত্মবিশ্লেষণ করার পরামর্শ দেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ অন্যান্য ঘটনা যাতে না ঘটে, তার কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। যেসব সংস্থা আইনের রক্ষক তারা যাতে ভক্ষক না হয়, সে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব যেসব প্রতিষ্ঠানের, দলীয় রাজনীতিকরণসহ নানা কারণে সেগুলোর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে অপরাধকারীদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গ তুলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই আইন কেন বাতিল করা প্রয়োজন, তা তথ্য–উপাত্ত দিয়ে সরকারকে জানানো হয়েছে। আইনটি ঝুঁকিপূর্ণ। আইনটিকে ঢেলে সাজানো হলেও তা কাজে আসবে না।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ অন্যান্য ঘটনা ঘটছে। ক্রসফায়ার স্বীকৃত সত্য, প্রতিনিয়ত ঘটছে। সংখ্যাকে প্রত্যাখ্যান না করে বিষয়গুলোকে আরও গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। এগুলো দেশে ঘটছে কি না, ঘটে থাকলে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনে তো বাধা থাকার কথা না।
নূর খান, আসকের নির্বাহী পরিচালক

পরামর্শ সভায় নূর খান বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ অন্যান্য ঘটনা ঘটছে। ক্রসফায়ার স্বীকৃত সত্য, প্রতিনিয়ত ঘটছে। সংখ্যাকে প্রত্যাখ্যান না করে বিষয়গুলোকে আরও গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। এগুলো দেশে ঘটছে কি না, ঘটে থাকলে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনে তো বাধা থাকার কথা না। কমিশন যদি মনে করে ঘটনা ঘটেছে, তাহলে চিহ্নিত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনবে।

বক্তব্যে জাতিসংঘের প্রতিনিধি উমা খান বলেন, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কতটুকু অগ্রগতি হলো, তা মনিটরিংয়ের জন্য একটি ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করার যে সুপারিশ, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে মেকানিজম (কৌশল) তৈরির বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দেন।

এইচআরএফবির সদস্য রঞ্জন কর্মকার স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়নের বিষয়ে গুরুত্ব দেন।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা যাঁরা দুর্বল, তাঁদের বেলাতেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ঘটছে; যা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেন এইচআরএফবির সদস্য সঞ্জীব দ্রং। তিনি বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে গুরুত্ব দেন।

সভায় উল্লেখ করা হয়, ইউপিআর প্রতিবেদন হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার ব্যবস্থার একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া; যার আওতায় এ সংস্থার ১৯৩টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সাড়ে চার বছর পরপর পর্যালোচনা করা হয়। পরিস্থিতির উন্নয়নে বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করে প্রতিটি দেশের সরকার। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয় জাতিসংঘের কাছে। বাংলাদেশের চতুর্থ পর্বের ইউপিআর প্রতিবেদন প্রণয়নের অংশ হিসেবে এ খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

২০১৮ সালের ১৪ মে ইউপিআরের তৃতীয় পর্বে ১০৫টি দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ ২৫১টি সুপারিশ পায়। এর মধ্যে সরকার ১৭৮টি সুপারিশ অনুসমর্থন করে। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে চতুর্থবারের মতো ইউপিআর পদ্ধতির আওতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা হতে যাচ্ছে।

২০২২ সালে রাজনৈতিক সংঘাত কম হয়েছে

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বললেই ঘুরেফিরে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় সামনে আনা হয়। এনজিওর লেবাসে রাজনৈতিক ব্যক্তি বা কারও স্বার্থে কেউ যাতে কোনো কিছু বাস্তবায়নের চেষ্টা না করে, সেই আহ্বান জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রসঙ্গ টানেন। বলেন, ‘অধিকার আইনকানুন মানেনি। নিবন্ধন বিষয়ে আপিলের আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। আবার আদালতে গেছে বিষয়টি সুরাহার জন্য।’

মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার যে ১৭৮টি সুপারিশ অনুসমর্থন করেছে, তা বাস্তবায়নে সমন্বয়ের জায়গায় ঘাটতি আছে বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।

শাহরিয়ার আলম বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের একার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব না। সবার অংশগ্রহণ না থাকলে তখন এর দায় সরকারের ঘাড়ে এসে পড়ে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের বেলায় আইনটির কিছু অপপ্রয়োগ হয়েছে। তাই সাংবাদিকদের বেলায় এটি প্রয়োগে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের অনুমতি নেওয়া হচ্ছে। তবে আইনটি বাতিল করার বাস্তবতা নেই, প্রয়োজনে আইনটি সংশোধন করার কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী। আর আইনটির অপব্যবহার রোধে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের কাউন্সেলিং করতে হবে।

নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২২ সালে রাজনৈতিক সংঘাত কম হয়েছে। বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডে বাধা না দেওয়ার নির্দেশ আছে। তবে রাজনীতির নামে কাউকে সহিংসতার ঘটনা ঘটাতে দেওয়া হবে না।

বাংলাদেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আর ফেরত যাবে না উল্লেখ করে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘দেশে এমন কোনো পরিস্থিতি ঘটেনি যে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন আইনের মাধ্যমেই সব পরিচালিত হবে।’

মৃত্যুদণ্ড বাতিল প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কেউ হলফ করে বলতে পারবে না যে দেশ থেকে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার সময় এসেছে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থাকে উপেক্ষা করে পশ্চিমা দেশ যা বলবে তার সবকিছুতে হ্যাঁ বলে দিলে তা দায়িত্বশীল আচরণ হবে না।