একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় আরও ১০৮ জনের নাম যুক্ত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী যাচাই–বাছাই কমিটি তৃতীয় পর্বে এসব নাম চূড়ান্ত ও অনুমোদন করেছে। এ নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা দাঁড়াল ৪৪২। তাঁদের মধ্যে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি।
৬ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী যাচাই–বাছাই কমিটির সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় নতুন নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, কমিটি নতুনভাবে ১০৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে বাছাই করতে পেরেছে। খুব শিগগির তাঁদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।
এর আগে দুই পর্বে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়। প্রথম পর্বে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ছিল ১৯১। দ্বিতীয় পর্বে সংখ্যা ছিল ১৪৩। তিন পর্ব মিলে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ৪৪২। এর মধ্যে শিক্ষক সবচেয়ে বেশি। তাঁদের সংখ্যা ১৪৩। এর পরে আছেন চিকিৎসক, ৯৯ জন। যাচাই–বাছাই কমিটি শহীদ বুদ্ধিজীবী খোঁজার কাজ অব্যাহত রাখবে।
কীভাবে তালিকা হয়
২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ের জন্য যাচাই–বাছাই কমিটির সদস্যদের নাম প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। তাতে কমিটির সদস্য ১১ জন।
এরপর দুটি উপকমিটি গঠিত হয়। একটি কমিটির কাজ ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। অন্য কমিটির কাজ সংজ্ঞা অনুসারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহ ও তা যাচাই–বাছাই করা।
দুটি কমিটিতেই আছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন, তা নিয়ে আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, বরেণ্য বুদ্ধিজীবী–শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলি। একটি খসড়া সংজ্ঞা দাঁড় করানো হয়। পরে জাতীয় কমিটি সেই সংজ্ঞা অনুমোদন করে।’
এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ২১ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে: ‘যে সকল সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীত ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁরা শহীদ বুদ্ধিজীবী।’
এই সংজ্ঞা সামনে রেখে তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা চালায় কমিটি ও মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় প্রথম পর্বে ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। এই পর্বে তথ্যের ভিত্তি ছিল, ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় প্রকাশিত একটি গ্রন্থ। তাতে শহীদ বুদ্ধিজীবী ১০৯ জনের তালিকা ছিল। এ ছাড়া ডাক বিভাগ ৯ পর্বে ১৫২ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল। যাচাই–বাছাই কমিটি এই দুটি তালিকা ধরে ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় দ্বিতীয় পর্বের তালিকা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে ২০২২ সালের ২৯ মে। ওই তালিকায় ১৪৩ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পর্বে তথ্যের ভিত্তি ছিল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে পাওয়া তালিকা এবং ব্যক্তিপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের গ্রন্থে থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম বা নামের তালিকা।
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের তালিকা প্রকাশের পর অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য আবেদন করতে থাকেন। কমিটি সেই আবেদন আমলে নিয়েছে। এ ছাড়া প্রজন্ম ৭১, রক্তঋণ, ১৯৭১: গণহত্যা–নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর থেকে নাম সংগ্রহ করেছে কমিটি। এরপর কমিটি যাচাই–বাছাই করে তৃতীয় পর্বের তালিকা চূড়ান্ত করেছে।
কমিটির সদস্যরা বলছেন, এখানেই তালিকা শেষ হচ্ছে না। ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমির কাছ থেকে আরও নতুন নামের ব্যাপারে জেনেছে মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া অনেক গবেষকের গবেষণা থেকে নাম সংগ্রহের পরামর্শ পাচ্ছে কমিটি। এসব নিয়ে চতুর্থ পর্বের তালিকা তৈরির কাজ করবে কমিটি।
তালিকায় বেশি শিক্ষক
যাচাই–বাছাই কমিটি তিন পর্বে মোট ১৬টি পেশার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষক। তিন তালিকায় তাঁদের ১৪৩ জনের নাম আছে। চিকিৎসক ৯৯, আইনজীবী ৪৬, প্রকৌশলী ৩৬, সরকারি কর্মচারী ২৬, সাংবাদিক ২১ জনের নাম আছে। তালিকায় সমাজসেবী আছেন ১৭ জন, রাজনীতিক ১৬ জন, সাহিত্যিক ১১ জন এবং সংস্কৃতিকর্মী আছেন ১০ জন। এ ছাড়া কণ্ঠশিল্পী আছেন ৭ জন, অভিনেতা ৪ জন, বেসরকারি কর্মচারী ও বিজ্ঞানী আছেন ২ জন করে এবং গবেষক ও কৃষি কর্মকর্তা আছেন ১ জন করে।
অধ্যাপক বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে যখন বাংলাদেশের বিজয় অনিবার্য হয়ে পড়েছে, তখনই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবী হত্যা আরও বাড়িয়ে দেয়। মূলত বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য তারা বুদ্ধিজীবীদের নিশানা করে।’