বাংলাদেশে সাধারণ ছাত্রদের জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি সমর্থন জানিয়েছেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এত দূরে থেকে কীভাবে আপনি ছাত্রদের আকুতি বুঝতে পারলেন?
আপসানা বেগম: যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে অনেকভাবেই অবগত ছিল। সংসদে অনেকে আমার মোশন উত্থাপনকে (একটি নির্দিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে পার্লামেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ) স্বাক্ষর করে সহমত জানিয়েছিলেন। ভালো দিক ছিল, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই এতে সহমত জানিয়েছিল। তরুণেরা চায় বাংলাদেশের উন্নতি হোক। দেশে সুন্দর পরিবর্তন আসুক, যেন দেশে থেকে সুন্দরভাবে বাঁচা যায়। তাই সবাই এগিয়ে এসেছিল। দেশে মানবাধিকারের বিষয়টা জোরদার হোক, সেটা খুব করে উঠে এসেছিল তরুণ জেন-জির মাধ্যমে। তারা জনগণকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল, যা বিরোধী দলগুলো পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি না থাকার কারণে করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আমাদের এ বিষয়গুলো ভাবা উচিত।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের তরুণ প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আপনি কীভাবে দেখেন?
আপসানা বেগম: আমার রাজনৈতিক জীবন এবং বিশ্বাস থেকে শেখা-সবকিছুতে সমবণ্টন, সবাইকে নিয়ে সুস্থ এবং নির্মল একটা সমাজ গড়া। বাংলাদেশের ছাত্ররা যা অর্জন করেছে, সেটা ঐতিহাসিক। এই অর্জনকে বিফল হতে দেওয়া যাবে না। বিগত সরকারের ব্যর্থতার কারণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সবাইকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা উচিত। সাধারণ মানুষের আস্থা হারানোই বিগত সরকারের পতনের মূল কারণ বলে আমি মনে করি। এখন নতুনভাবে সবাই মিলে আবার সুন্দর করে গড়ে তুলবে, এটাই আশা করি।
বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রোপার্টির সন্ধান যুক্তরাজ্যে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৭০টির মতো আপনার নির্বাচনী এলাকা পপলার অ্যান্ড লাইম হাউসে। বিষয়টি নিয়ে তদন্তের জন্য আপনি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) কাছে চিঠি লিখেছেন। জবাব পেলেন?
আপসানা বেগম: প্রথমেই বলব, আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব অবাক হয়েছি। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, আমাদের জানামতে যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়ও অনেক সম্পদ রয়েছে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর। আমার নিজ নির্বাচনী এলাকাতেই তাঁর (সাইফুজ্জামান) ৭২টি সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই এ বিষয়ে নজর দিয়েছি। আমার অবস্থান হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারসহ যারাই দুর্নীতি করেছে, সব খতিয়ে দেখা উচিত এবং অনুসন্ধান করা উচিত। কারণ, বাংলাদেশ অনেক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উচিত এটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
আর আপনি যেটা বলেছেন, এনসিএর জবাব পেয়েছি কি না। আসলে আমি ওদের কাছে অনুসন্ধান করার সহায়তা চেয়েছি। আমার জানামতে, মহাপরিচালকের কার্যালয় বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। টাওয়ার হ্যামলেটসে অনেক বাংলাদেশি আছেন। তাঁরাও চান এর সঠিক বিচার হোক।
সাইফুদ্দিন চৌধুরী ছাড়াও অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ অবৈধ সম্পদ যুক্তরাজ্যে পাচার করেছেন বলে শোনা যায়। এই সম্পদ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কীভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তা পেতে পারে?
আপসানা বেগম: মানি লন্ডারিং এবং সম্পত্তি চুরি করার বিষয়টা পুরো দেশকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে দেয়। আমরা যারা তৃণমূল থেকে এসেছি, তাঁরা চাই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াক। কোনো সন্দেহ নেই এসব ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তা দরকার হবে। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো... যুক্তরাজ্যে বেড়ে ওঠা এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে আমি জানি, বাংলাদেশের অনেক মানুষ যুক্তরাজ্যসহ সারা বিশ্বে বাস করেন। অভিবাসীর সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানে। আমাদের যুক্তরাজ্যের আলাদা একটা লিগ্যাসি আছে, যা আর কারও নেই। মহামারি কভিড দেখিয়ে দিয়ে গেছে যে বৈষম্যের কারণে কীভাবে বিশ্বজুড়ে দরিদ্র আর দুর্বল মানুষেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবকিছু ভেবে দেখলে আমি মনে করি, যুক্তরাজ্যের যে লিগ্যাসি, সেই দিক থেকে বাংলাদেশকে যুক্তরাজ্যে করা উচিত।
লেবার পার্টির পার্লামেন্টারি কমিটি থেকে আপনাকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এর আগেও আমরা আপনার সঙ্গে পার্টির দূরত্ব লক্ষ করেছি। এটা কি দলের সাবেক প্রধান জেরেমি করবিনের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতার কারণে, নাকি অন্য কিছু?
আপসানা বেগম: মূল দল থেকে নয়, লেবার পার্টির পার্লামেন্টারি দল থেকে সাসপেন্ড হয়েছি ছয় মাসের জন্য। আমি বড় হয়েছি একটা সামাজিক রীতিনীতি মেনে। আর এই নীতির কারণে আমার রাজনৈতিক জীবনে সব সময় ন্যায়ের পক্ষে থেকেছি।...আমি শিশুদের সামাজিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তুলে দেওয়ার পক্ষে ছিলাম। আমার নীতি থেকে আমি এই অবস্থান নিয়েছিলাম। আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষও আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। তবে অবশ্যই আমি জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনা করি এবং আমি আমার নীতি ও আমার নির্বাচনী এলাকার স্বার্থকে প্রাধান্য দেই।
গাজা যুদ্ধ নিয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে আপনি পার্লামেন্ট ও পার্লামেন্টের বাইরে বেশ সরব ভূমিকা পালন করছেন। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে আপনি আপনার দলের বিরুদ্ধে গিয়েও ভোট দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি কীভাবে দেখছেন?
আপসানা বেগম: গাজায় এমন আগ্রাসন কোনোভাবেই মানা যায় না। এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে, যেখানে শিশুদের সংখ্যা অনেক বেশি। আমি সংসদে এটা সব সময় বলে এসেছি, ভবিষ্যতেও বলে যাব। যখন যে সরকারই থাকুক, এটার বিচারের পক্ষে থাকা উচিত। সম্প্রতি আমার সরকারও আমার এ মতের পক্ষে এবং যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। যুক্তরাজ্যের মানুষও যুদ্ধবিরতির পক্ষে। যুদ্ধের অস্ত্র কেনাবেচা একটা বড় বিষয়। যেহেতু যুক্তরাজ্যের নিজস্ব একটা শক্তিশালী অবকাঠামো আছে, তাই এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের অবস্থান কী হয় সেটা লক্ষণীয়। আমার দিক থেকে বারবার আমার কথা বলে যাব, সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যেন নজর দেন।
একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে ভবিষ্যতে আপনি নিজেকে কোথায় দেখাতে চান?
আপসানা বেগম: এমপি হব, রাজনীতিতে আসব—ছোটবেলায় এমন চিন্তা করিনি। আমার রাজনীতিতে আসা বিভিন্ন স্থানীয় প্রচারণাগুলো দেখে, মানুষের সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখে—সেগুলোই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে রাজনীতিতে যোগ দিতে। মানুষ আমাকে নির্বাচিত করেছে, মানুষের সমস্যা নিয়ে আমি কথা বলব, তাদের জন্য কাজ করা আমার অগ্রাধিকারে থাকবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপসানা বেগম: আপনাকেও ধন্যবাদ।