‘আব্বু ওরা টাকা চাইছে, কী করব’
বছর চারেক আগে পপি ও সোহেল পরিবারের কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেন। গ্রামে নানা দেনদরবারের পর দুই পরিবার বিয়ে মেনে নেয়। তবে তাঁদের সংসার শেষ হয়ে গেছে তিন বছরের মধ্যেই।
গত বছরের ১২ এপ্রিল মাগুরার সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়নের বিল আকছি গ্রামে শ্বশুরবাড়ি থেকে পপির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। পপির বাবা ও পরিবারের অভিযোগ, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে দিয়েছে।
এ বছরের ৩০ এপ্রিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রতিবেদনে পপির মৃত্যুকে ‘স্বামীর প্ররোচনায় আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে যৌতুক, ক্রমাগত মানসিক নির্যাতন ও সন্তান না হওয়ার জন্য স্বামীর উপহাস করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পপিকে তাঁর স্বামী প্রায়ই বলতেন, চেহারা ‘সুন্দর’ দেখে বিয়ে করে এখন তাঁর জীবন ‘নষ্ট’, পপি মরে গেলে তিনি বেঁচে যেতেন।
পপি খাতুন (২১) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। আর তাঁর স্বামী মো. সোহেল হোসেন (২৭) ইজিবাইকচালক। তিনি স্কুলে কিছুদূর পড়াশোনা করেছিলেন।
ঘটনাটির বিষয়ে জানতে ১৭ আগস্ট প্রথম আলো মাগুরার শালিখা উপজেলায় জুনারি গ্রামে গিয়ে পপির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে।
পপির পরিবারের অভিযোগ, যৌতুকের কারণে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন পপিকে হত্যা করেছে। মৃত্যুর সময় পপি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। পপির মৃত্যুর পর তাঁরা দুই দিন ঘুরলেও মাগুরা সদর থানা অভিযোগ নেয়নি। পরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গিয়ে তাঁরা মামলা করেন।
বারবার যৌতুক চাওয়ার অভিযোগ
পপির মামা মো. সেলিমের বাড়ির পাশে ছিল সোহেলদের বাড়ি। মামাবাড়ি আসা-যাওয়ার সুবাদে সোহেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয় পপির।
মামলার বাদী পপির বাবা আনিচুর রহমান বলেন, মেয়ের বিয়ের পর সোহেল ইজিবাইক কেনার জন্য টাকা চাইলে তিনি এক লাখ টাকা দেন। পরে বিদেশে যাওয়ার জন্য আরও এক লাখ টাকা দাবি করেন সোহেল। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন চাপ দিতে থাকে পপিকে।
পপির বাবা আরও বলেন, সেদিন (যেদিন পপির লাশ উদ্ধার করা হয়) খুব সকালে মেয়ে তাঁকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘আব্বু, ওরা আমার কাছে টাকা চাইছে, কী করব?’। তিনি মেয়েকে বলেন, ‘আমি এখন এত টাকা কোথায় পাব?’
পিবিআইয়ের প্রতিবেদনেও ইজিবাইক কেনার জন্য এক লাখ টাকা দেওয়া ও সম্প্রতি বিদেশে যাওয়ার জন্য আরও এক লাখ টাকা যৌতুক দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
পপির দাদি রিজিয়া বেগম প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘বিয়ের সময় এক লাখ টাকা দিছিলাম। সেটা দিয়ে কী করিছে, আল্লাহই জানে! সোহেল আর ওর মা-বাপ খালি টাকা চাইত।’ তিনি আরও অভিযোগ করেন, ঘরের কাজ নিয়েও শ্বশুরবাড়ির লোকজন পপিকে কথা শোনাত। ঘটনার দিন সকাল ১০টার দিকে পপি তাঁর নানিকে ফোন করে বাসায় আসতে বলে। নানি বাসায় গেলে বলে, গোসল সেরে এসে কথা বলবে। নানি পরে আসবেন জানিয়ে বাসায় ফিরে যান। সাড়ে ১০টার দিকে নানির মুঠোফোনে জানানো হয়, পপি ঘরের আড়ায় ওড়নায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর পপিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন হাসপাতালে লাশ রেখে চলে যান বলছে পপির পরিবার।
রিজিয়া বেগম আরও অভিযোগ করেন, গোসল করতে গেলে বালতির পানিতে পপির মাথা ডুবিয়ে হত্যা করে ঘরে নিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পপির শ্বশুর ওয়াদুদ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পাঁচ ছেলে সবাই কাজ করেন। তাঁরা কোনো দিন যৌতুক দাবি করেননি। পপিকে তাঁরা খুবই ভালোবাসতেন। পপি ও সোহেলের মধ্যেও সম্পর্ক ভালো ছিল। সোহেল কোথায় আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাড়িতেই আছে। ও কী অপরাধ করছে যে পালাবে!’
ওয়াদুদ মোল্লা আরও বলেন, তাঁর পরিবার দরিদ্র। এ কারণে পপির বাড়ির লোকজনের এই বিয়েতে আপত্তি ছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই তাঁদের হয়রানি করার জন্য মামলা করেছেন পপির বাবা।
থানায় মামলা না নেওয়ার অভিযোগ
পপির দাদি রিজিয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, পপির মৃত্যুর পর তাঁরা দুইবার মাগুরা সদর থানায় মামলা করার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু মামলা নেওয়া হবে না জানিয়ে থানা থেকে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গত বছরের ১৭ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ (ক) (যৌতুকের কারণে মৃত্যু ঘটানো, ইত্যাদি) ধারায় পপির স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাশুর, দেবর ও দুই জাসহ মোট সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
তবে পপির পরিবার মামলা করতে আসেনি বলছেন পপির মৃত্যুর পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা মাগুরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ইমরুল হুসাইন খান। তিনি বলেন, ওই দিন থানা থেকে একটি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়।
থানা কেন মামলা নেয়নি জানতে চাইলে মাগুরা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ সেকেন্দার আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পরে দায়িত্ব নিয়েছেন। মামলা কেন নেওয়া হয়নি, তা জানেন না।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগী চাইলে পুলিশকে মামলা নিতে হয়। এ ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় দেখা যায়, পুলিশ এটাকে বাড়তি কাজ বলে মনে করে। ফলে ভুক্তভোগীদের আদালতের আশ্রয় নিতে হয়। তিনি আরও বলেন, এভাবে পরিবার, সমাজ ও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো উপেক্ষিত হলে এ ধরনের অপরাধের মাত্রা বাড়ে।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ৯টি জাতীয় পত্রিকা, কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংগঠনের নিজস্ব তথ্যসংকলিত করে জানিয়েছে, ২০২২ সালে ১৭৪টি যৌতুকের কারণে নির্যাতনের খবর প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ৭৯টি হত্যা ও ৭টি আত্মহত্যার ঘটনা রয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত যৌতুকের কারণে ৮৯টি নির্যাতনের খবর প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি হত্যা ও ৫টি আত্মহত্যার ঘটনা রয়েছে।
জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ এ তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে কল এসেছে ১৫ হাজার ৯৫২টি। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৩৭০টি পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুকের কারণে নির্যাতনের কল ২৬৩টি।