চীন নিবিড় কৌশলগত অংশীদার হতে চায়
৮ জুলাই চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন ঢাকা সফরে রয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল।
আট বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ক চিরাচরিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে কৌশলগত সহযোগিতায় উত্তরণ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের বেইজিং সফরে চীন এ সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘নিবিড় কৌশলগত অংশীদারত্বে’ রূপ দিতে চাইছে।
সি চিন পিংয়ের ওই সফরের মধ্য দিয়ে চীনের অঞ্চল ও পথের উদ্যোগে (বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভ) যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। এবার চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশ যুক্ত হবে। আর বাংলাদেশের পরিকল্পিত দক্ষিণাঞ্চলীয় সমন্বিত অবকাঠামো উদ্যোগে (সিডি) চীনের যুক্ততার ঘোষণা আসতে যাচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি প্রচারিত হবে, তাতে সম্পর্কের উত্তরণের প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে।
কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে সরকার বেশ কয়েক বছর আগে উন্নয়ন অবকাঠামো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। জাপানের বঙ্গোপসাগরীয় শিল্পাঞ্চল প্রবৃদ্ধি বলয়ে (দ্য বিগ বি ইনিশিয়েটিভ) যুক্ত হয়ে সরকার সমন্বিতভাবে এই উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় সরকার পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (সিডি) নিচ্ছে। বাংলাদেশ চাইছে সিডি বাস্তবায়নে অংশীদার হোক চীন। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে বেইজিংয়ের রাজনৈতিক মহলসহ নানা স্তরে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বিষয়টি জানানো হয়েছে বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছে।
৮ জুলাই শুরু হওয়া প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে নতুন প্রকল্পে অর্থায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের বাজেট-ঘাটতি পূরণে আর্থিক সহায়তার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে। এ নিয়ে শেষ মুহূর্তের আলোচনার জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সফর করছে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এখনো দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। এই মুহূর্তে চীনের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছে। চীনের কাছ থেকে বাজেটে সহায়তার পাশাপাশি অন্যান্য প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা নেওয়ার মতো বিষয়গুলোও আমরা যাচাই করার চেষ্টা করছি।’
সম্পর্কের উত্তরণ
২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের সময় দুই দেশের সহযোগিতা ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হয়। তখন চীনের বিআরআই নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই ছাড়াও বাংলাদেশের বেশ কিছু বৃহদায়তন উন্নয়ন অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের ঋণ ও অর্থায়নের সিদ্ধান্ত হয়। বিআরআইয়ের অন্যতম প্রকল্প হিসেবে পদ্মা রেল সেতু নির্মাণে ঋণ দিয়েছে চীন।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে আগ্রহী চীন। সাধারণত এ ধরনের শীর্ষ বৈঠকে স্বাগতিক দেশের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিসহ সংশ্লিষ্ট নানা সরকারি দলিলের খসড়া তৈরি করে স্বাগতিক দেশ। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এবারের সফরে স্বাগতিক দেশ চীন তাদের যৌথ বিবৃতির খসড়ায় সম্পর্ক উত্তরণে ‘নিবিড় কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বের’ প্রস্তাব করেছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগী চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে এই বার্তাই দিয়ে গেছেন সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও। আগামী বছর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপিত হবে। ওই উদ্যাপন ঘিরে দুই দেশের সমাজের নানা স্তরে যোগাযোগ বাড়াতে বিশেষভাবে জোর দিচ্ছে চীন।
সামগ্রিকভাবে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের উত্তরণ আর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিবিড় করার বিষয়টি যৌথ বিবৃতিতে প্রতিফলিত হবে—সংশ্লিষ্ট একাধিক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এ প্রতিবেদকের কাছে তা নিশ্চিত করেছেন।
পায়রাকে ঘিরে সিডিতে চীনকে যুক্ততায় জোর
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশেষ করে এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগে (সিডি) চীনের অংশীদারত্ব কিংবা সহযোগিতার বিষয়টি সরকার সামনে এনেছে।
গত ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। এরপর ৩ জুন বেইজিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী (সচিব) সুন ওয়েডং। সর্বশেষ ২৪ জুন ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও দেখা করেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওই তিন আলোচনায় সিডিতে চীনের সহযোগিতা নিয়ে আগ্রহের কথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে বাংলাদেশ।
একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সৌজন্য সাক্ষাতের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সহযোগিতার ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকারের বিষয়ে পরামর্শ চান। তখন শেখ হাসিনা তাঁকে পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় চীনের বিনিয়োগের কথা জানান। ওই বৈঠকের এক সপ্তাহে পর সরেজমিনে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে চীনা রাষ্ট্রদূত পায়রা সমুদ্রবন্দর ও এর আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের আগে সিপিসির মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাওয়ের ঢাকা সফরটি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বিষয়গুলো কেমন, তা তিনি ঢাকায় এসে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। জানা গেছে, লিউ জিয়ানছাওয়ের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে সরকারের সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়টি তুলে ধরেন।
পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে সিডির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে আঞ্চলিক সংযুক্তির কেন্দ্র গড়ে তুলতে সরকার মনোযোগ দিচ্ছে। একই ভাবে সরকার পায়রা সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্রে রেখে দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগের কাজটা করবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এটি মূলত ওই অঞ্চলের ভবিষ্যতের উন্নয়নের রূপরেখা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রকল্পের প্রস্তাব ইআরডির কাছে জমা দেবে। এরপর সব কটি সমন্বয় করে তার তালিকা করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ নিয়ে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে চীন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে—এটি যৌথ বিবৃতিতে যুক্ত করতে চাইছে ঢাকা। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে উন্নয়ন উদ্যোগে চীনকে যুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাবকে ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা বলেই মনে করি। জাপানকে বাংলাদেশ যুক্ত করেছে মাতারবাড়ীতে, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের পর তিস্তায় চীনকে যুক্ত না করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ফলে পায়রা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চীনকে যুক্ত করা মানেই দেশটিকে খুশি করে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা। পাশাপাশি চীনকে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত রেখে যতটা সম্ভব আর্থিক সহায়তার দ্বার উন্মুক্ত রাখাও এর উদ্দেশ্য।’