আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের তর্ক, হইচই ও হট্টগোলের মধ্যে একপর্যায়ে এজলাস ত্যাগ করেন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের দুই বিচারপতি।
আজ সোমবার সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটের দিকে এজলাস ছাড়ার পরে বেলা দুইটা ৩৫ মিনিটের দিকে আবার এজলাসে আসেন দুই বিচারপতি। আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়।
আইনের দৃষ্টিতে পলাতক অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরাতে বিটিআরসিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে রিট আবেদনকারীর আবেদন মঞ্জুরের পর আজ এ ঘটনা ঘটে।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আবেদনটি মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এরপর আদালতে উপস্থিত হয়ে এ নিয়ে আপত্তি জানান বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
হইচই, তর্ক ও হট্টগোল
১০টা ৪০ মিনিটের দিকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতের উদ্দেশে বলেন, প্রধান বিচারপতির কাছে অন্য আদালতে এ–সংক্রান্ত রিটটি বদলির জন্য গতকাল রোববার আবেদন দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আদেশ দেওয়া সমীচীন নয়। আবেদনটি (তারেকের বক্তব্য সরাতে করা) নথিভুক্ত রাখেন। অপেক্ষা করুন। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিটিআরসির আইনজীবী কথা বলেন—‘এটি কী? কী হচ্ছে?’
এরপর আবেদন মঞ্জুর করা নিয়ে আবার আপত্তি জানাতে শুরু করেন বিএনপিপন্থী কয়েকজন আইনজীবী। তখন আদালত বলেন, ‘আপনাদের সবার বলা শেষ হলে কিছু বলব।’ এ সময় বিএনপিপন্থী একজন আইনজীবী বলেন, ‘ইটস লাইক আ গেম শো।’ আদালত বলেন, ‘আমরা একটু বলি।’ তখন বিএনপিপন্থী একাধিক আইনজীবী বলেন, ‘না, মাই লর্ড।’
একপর্যায়ে বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতির উদ্দেশে বিএনপিপন্থী এক আইনজীবী বলেন, ‘আমরা না বললে মানুষ ভুল বুঝবে।’ তখন আদালত বলেন, ‘ভুল বুঝবে না। প্রধান বিচারপতির কাছে দেওয়া আবেদন সম্পর্কে আপনি অবহিত নন? দরখাস্তটি আপনি দেখবেন না, অথচ আবেদন সম্পর্কে আপনি অবগত।’
এর একপর্যায়ে হইচই শুরু হয়। আদালত বলেন, ‘আপনাদের বলা শেষ হলো আমরা বলব।’ বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বিএনপিপন্থী এক আইনজীবী বলেন, ‘আপনাকে বলতে হবে যে আপনি দরখাস্ত সম্পর্কে জানেন কি না? আপনি বলে দেন আমরা যা–ই বলি না কেন, আপনি রায় দেবেন। তাহলে আমরা এখানে দাঁড়াব না। মিডিয়াতে যাবে।’ একপর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তাঁরা মিডিয়া ট্রায়াল চাচ্ছেন।
আদালত বলেন, ‘আদেশ দেওয়ার আগে যদি আপনারা একটু বলতেন।’ এ সময় উচ্চ স্বরে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলেন, বলা হয়েছে। বলা হয়েছে। কোর্টের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে।
এ সময় একাধিক আইন কর্মকর্তা বলেন, এটি কোর্ট, এখানে শাউটিং করা যাবে না। তখন বিএনপিপন্থী একজন আইনজীবী বলেন, ‘হু ইজ হি?’ এরপর পরই আবার শুরু হয় হইচই ও হট্টগোল।
এজলাস ত্যাগ ও বিএনপিপন্থীদের অবস্থান
হইচইয়ের মধ্যে একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আদেশ দেওয়া হয়েছে, সংক্ষুব্ধ হলে আপনারা আপিল বিভাগে যেতে পারেন।’
এ সময় বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বিএনপিপন্থী একাধিক আইনজীবী বলেন, ‘আপনি বায়াস, আপনার প্রতি আস্থা নেই।’ তখন বিচারকের উদ্দেশে একজন আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনাকে কেউ জোর করে আদেশ নিতে পারবে না।’ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বিএনপিপন্থী একাধিক আইনজীবী উচ্চ স্বরে বলেন, ‘এই চুপ, চুপ।’ তখন বিচারকদের উদ্দেশে ওই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা আপনাদের মতো করে কোর্ট চালাবেন। ক্রমানুসারে মামলা ডাকা হোক।’
এ নিয়ে একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক, তুমুল হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়।
একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আমরা আদেশ দিয়েছি। এখন নিয়মিত আইটেমে (কার্যতালিকায় থাকা অন্য মামলা) যাই।’ এতে আপত্তি জানিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা 'নো’ ‘নো' বলতে থাকেন। রিটটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। আদেশ প্রত্যাহার করেন। বিচারপতির উদ্দেশে বিএনপিপন্থী একজন আইনজীবী বলেন, ‘আপনি অ্যানার্কি তৈরি করছেন জুডিশিয়ারিতে।’ এতে আপত্তি জানান একাধিক আইন কর্মকর্তা। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের কয়েকজন 'সেইম' 'সেইম' বলেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্য তর্ক ও হইচই হয়।
এর একপর্যায়ে ১০টা ৫৫ মিনিটের দিকে এজলাস ত্যাগ করেন দুই বিচারপতি। এ সময় বিচারপতির দিকে একজন আইনজীবীকে কার্যতালিকা ছুড়ে মারেন। বেলা সোয়া একটা পর্যন্ত আদালত কক্ষে বসেছিলেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী কামরুল ইসলাম ও সানজিদা খানম উপস্থিত ছিলেন। বিএনপিপন্থী আইনজীবী কায়সার কামাল, এম বদরুদ্দোজা, মো. রুহুল কুদ্দুস ও গাজী কামরুল ইসলাম প্রমুখ কথা বলেন। এ জে মোহাম্মদ আলী ও এ এম মাহবুব উদ্দিনসহ (খোকন) বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার ও কামরুল হাসান খান (আসলাম), সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান, এস আর সিদ্দিকী সাইফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আট বছর আগে রিট
২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী লিনা হাইকোর্টে একটি রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে পরদিন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন।
আইনের দৃষ্টিতে পলাতক অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কোনো ধরনের বক্তব্য বা বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সম্প্রতি রুল শুনানির উদ্যোগ নেয় রিট আবেদনকারীপক্ষ। এর ধারাবাহিকতায় চলতি মাসের শুরুতে বিষয়টি আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে। বিদেশে থাকায় তারেক রহমানের প্রতি নোটিশ জারি না হয়ে ২ আগস্ট তা ফেরত আসে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। রিটে বিবাদী হিসেবে তারেক রহমানের উল্লেখিত ঠিকানা (বাড়ি নম্বর-৬, রুম নম্বর-৮৬) সঠিক নয় বলে ১০ আগস্ট শুনানিতে ওঠে।
আদালত রিট আবেদনকারীপক্ষকে রিটে উল্লেখিত ঠিকানা সংশোধনের জন্য আবেদন দিতে বলেন। সেদিনই হলফনামা আকারে বিবাদী হিসেবে তারেক রহমানের উল্লেখিত ঠিকানা সংশোধন এবং তার প্রতি নোটিশ জারির (রুল) জন্য আবেদন জমা দেন রিট আবেদনকারী।
এরপর ১৩ আগস্ট হাইকোর্ট ওই রিট সূত্রে উল্লেখিত সংশোধিত ঠিকানায় (বাড়ি নং ৬, সড়ক-৮৬, গুলশান-২) বিবাদী তারেক রহমানের প্রতি বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে নোটিশ জারি করতে নির্দেশ দেন। এরপর তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউব থেকে সরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিটিআরসির প্রতি নির্দেশ চেয়ে সম্পূরক আবেদন করে রিট আবেদনকারী, যা মঞ্জুর করে আদেশ দেন হাইকোর্ট।