মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সরকারি ভাতাভোগীর মুঠোফোনে সরাসরি ভাতা পাঠানো শুরু হয় গত বছরের এপ্রিলে। আর গত বছরই এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আট মাসে সারা দেশ থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরে অভিযোগ এসেছে ১১ হাজার।
এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে—ভাতার টাকা না পাওয়া, মুঠোফোনের নম্বর ভুল এন্ট্রি করা, টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে চলে যাওয়া, প্রতারণার শিকার হওয়া ইত্যাদি। প্রকাশ্যে পিন নম্বর দেওয়ায় ভাতা না পাওয়ার অভিযোগও এসেছে।
বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি—এই চার ধরনের ভাতাভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগগুলো এসেছে।
১১ হাজার অভিযোগ প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমবারের মতো এত বড় একটি কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে এক কোটির বেশি ভাতাভোগীর তুলনায় অভিযোগের সংখ্যা কম। প্রতিটি অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে এবং অভিযোগের ধরন অনুযায়ী সমাধান দেওয়া হয়েছে।
প্রকাশ্যে পিন নম্বর দেওয়ার অভিযোগ
ভাতাভোগীর পরিবারের সদস্য আনোয়ার হোসেন এবং রুমা আক্তার বলছেন, সমাজসেবা কর্মকর্তা ও মোবাইল ফোনে অর্থ লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (নগদ) প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে পিন নম্বর দেওয়ায় তাঁরা কয়েক মাসের ভাতার টাকা পাননি। আনোয়ার হোসেন ও রুমা আক্তার দুই পরিবারের হলেও পেয়েছিলেন একই পিন নম্বর।
আনোয়ার হোসেন রাজধানীর হাজারীবাগের ভাগলপুর লেনের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাঁর ছেলে আশফাক আহমেদ আবির (১৩) ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। ২০২০ সালের অক্টোবরে সমাজসেবা আজিমপুর শাখা থেকে ‘নগদ’–এ তার অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয় এবং তাকে চার সংখ্যার একটি পিন নম্বর ভাতার বইয়ের ওপর লিখে দেওয়া হয়। কোনো গোপনীয়তা ছিল না। দীর্ঘ সময়েও মুঠোফোনে বার্তা না আসায় গত বছরের অক্টোবরে সমাজসেবা শাখায় খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারেন, তার অ্যাকাউন্টে ৯ মাসে ৬ হাজার ৭৫০ টাকা পাঠানো হয়েছিল। সাড়ে ৪ হাজার টাকা কেউ একজন তুলে নিয়েছে।
আনোয়ার হোসেনকে যে পিন নম্বর দেওয়া হয়েছিল, সেই একই পিন নম্বর দেওয়া হয়েছিল রাজধানীর ইসলামবাগের বাসিন্দা রুমা আক্তারের আট বছরের প্রতিবন্ধী ছেলে ইয়াসিনকেও (প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি)। ইয়াসিনের ছয় মাসের ভাতার টাকা অন্য কেউ তুলে নিয়েছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নগদের গণযোগাযোগ বিভাগের প্রধান জাহিদুল ইসলাম লিখিত বক্তব্যে জানান, সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বিতরণের অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে একই পিন নম্বর একাধিক ভাতাভোগীকে দিয়ে দেওয়ার কোনো অভিযোগ নগদের কাছে আসেনি। এমন অভিযোগ ওঠার কোনো সুযোগও নেই। কারণ, অ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়টি পুরোপুরি ভাতাভোগীর দায়িত্ব। তারপরেও সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুরোধে কোথাও কোথাও অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে নগদের তরফ থেকে কর্মী নিয়োজিত করা হয়। সমাজসেবা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তাঁদেরই কার্যালয়ে এসব প্রতিনিধি মূলত গ্রাহককে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিয়েছেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথমবারের মতো এত বড় একটি কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল। ফলে কিছু ভুল হয়েছে। ২০২১ সালে প্রথম এক বছর যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছিল, সেগুলো সময়ে সময়ে সংশোধনের কারণে এখন অভিযোগ আসা কমে গেছে।
আনোয়ার ও রুমা গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা যেদিন এন্ট্রির জন্য গিয়েছিলেন, সেদিন সবাইকে একই পিন নম্বর দেওয়া হয়। পিন নম্বর যে গোপন রাখতে হয়, সেটিও তাঁদের জানানো হয়নি। তাঁরা সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু টাকাটা আর উদ্ধার করা যায়নি। কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুসারে পরে পিন নম্বর পরিবর্তনের পর টাকা আর খোয়া যায়নি।
কারা ভাতা পাচ্ছেন
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, এখন ৪৯২টি উপজেলা, ৮০টি শহর সমাজ উন্নয়ন (ইউসিডি) কার্যক্রমসহ মোট ৫৭২টি ইউনিট থেকে ১১ ধরনের ভাতাভোগীকে জিটুপি পদ্ধতিতে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৬ জন। এর মধ্যে মাসে ৫০০ টাকা করে ৫৭ লাখ ১ হাজার জন বয়স্ক ভাতা ও ২৪ লাখ ৭৫ হাজার জন বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, ৮৫০ টাকা করে ২৩ লাখ ৬৫ হাজার প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন।
এ ছাড়া প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর অনুপাতে মাসে সর্বনিম্ন ৭৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৩০০ টাকা করে ১ লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন। অর্থাৎ এই চার ধরনের ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৬ লাখ ৪১ হাজার। অন্যরা হচ্ছেন—চা–বাগানের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা উপবৃত্তি, বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ও বেদে জনগোষ্ঠীর শিক্ষা উপবৃত্তি এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর শিক্ষা উপবৃত্তির ভাতাভোগী।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, মুঠোফোনে অর্থ লেনদেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে ১ কোটির বেশি ভাতাভোগীর মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। ওই অ্যাকাউন্টগুলোর ৭৫ শতাংশ নগদের এবং ২৫ শতাংশ বিকাশের। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে জিটুপি পদ্ধতিতে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে ভাতাভোগীদের অ্যাকাউন্ট ডিজিটাইজেশনের কাজ শুরু হয়।
অভিযোগ নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বক্তব্য
সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাতাভোগীদের অসচেতনতার কারণে তাঁরা ভাতার টাকা ঠিকঠাক পাননি। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে বয়স্ক ভাতার ক্ষেত্রে। এই ভাতাভোগীদের প্রায় কারও নিজস্ব মুঠোফোন নেই। দেখা গেছে, অনেক বয়স্ক ভাতাভোগী পরিবারের এক সদস্যের মুঠোফোন নম্বর দিয়ে এন্ট্রি করেছিলেন। সেই ব্যক্তি ভাতার টাকা পৌঁছে দিচ্ছেন না। কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয় নয়, এমন নম্বরগুলো দিয়েছিলেন ভাতাভোগীরা। ফলে সেসব মুঠোফোনে ভাতার টাকা না গিয়ে বাউন্স ব্যাক (ফিরে গেছে) হয়ে জমা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। ২০২০-২১ অর্থবছরের সেই টাকাগুলো এ বছরের জুলাই–আগস্ট মাসে ভাতাভোগীদের কাছে পাঠিয়ে সমস্যা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, বাংলামোটর, পরীবাগ এলাকা) কাউন্সিলর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জিটুপি শুরু হওয়ার পরপর বেশ কিছু অভিযোগ এসেছিল ভাতাভোগীদের কাছ থেকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত, তাঁরা হয় ভুল মুঠোফোন নম্বর দিয়েছেন অথবা অপারেটর এন্ট্রি করতে গিয়ে কোনো একটা ডিজিট ভুল করেছে বা পিন নম্বর অন্যরা জানে।