পাঠকের লেখা–৪১
স্কুল পালানোর দিনগুলো
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিনগুলোও ক্রমেই স্মৃতি হচ্ছে; কিন্তু ফেলে আসা স্কুলের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে।
২০১৪ সাল। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। বাইরে শান্তশিষ্ট আর লাজুক চেহারার কারণে সবাই আমাকে খুব লক্ষ্মী মেয়ে ভাবলেও আমি একদমই তেমন ছিলাম না। মনের ভেতর এক দুষ্টু পাখি সব সময় ছটফট করত। এদিকে মনের মতো দুই সখী জুটে যাওয়ায় আর কোনো অসুবিধা হলো না।
সুনামগঞ্জে আমাদের স্কুলের পেছনের নদীর পাশে যে গ্রাম, তার নাম শ্রীধরপুর। একদিন স্কুলে এসে শুনলাম, ওই গ্রামে কী এক মেলা বসেছে। অনেক দূর থেকে নাকি মানুষ আসছে দেখতে। আমি প্রথমে পাত্তা দিইনি; কিন্তু যখন ইতি আর জুঁইয়ের মুখে মেলার দারুণ সব বিবরণ শুনলাম, তখন পণ করলাম, যেকোনো মূল্যে আমার সেখানে যেতেই হবে।
প্রতিবছর হিন্দু সম্প্রদায়ের চড়কপূজা উপলক্ষে ওই মেলা বসে। মেলা চলে তিন দিন ধরে। সেই মেলায় দোকানপাট ছাড়াও একটি আকর্ষণীয় দিক হলো, পূজা উপলক্ষে সেখানে অনেক সন্ন্যাসী আসেন। অনেক রকম খেলা দেখান। এই যেমন মাটিতে গর্ত করে ঢুকে যান। ওপর থেকে অন্যজন মাটিচাপা দিয়ে দিলেও কিছুক্ষণ পর আবার সুস্থভাবে বের হয়ে আসেন। জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে যান। আরও কত কী!
মেলা শেষ হতে আরও এক দিন বাকি ছিল। আমরা তিনজন মিলে ঠিক করলাম, কাল বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসব। পরে স্কুল ছুটি হলে মেলায় যাব। পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন মায়ের অনুমতি আর সঙ্গে দেড় শ টাকা নিয়ে স্কুলে হাজির হলাম।
মেলা শেষ হবে বিকেলে। তাই যেতে হলে টিফিন পিরিয়ডে স্কুল পালাতে হবে। আমাদের জন্য কাজটি ছিল প্রায় অসম্ভব। কোনো দিন স্কুল পালাইনি। অন্যদিকে আমার বান্ধবীদেরও সাহস হচ্ছিল না দেখে মনে হলো, হয়তো যাওয়াই হবে না। কিছুক্ষণ পর দেখি, এক মেয়ে শ্রেণিশিক্ষকের কাছে পেটব্যথার অজুহাতে ছুটি নিয়ে নিল। আমরাও প্রথমে পদ্ধতিটা কাজে লাগালাম। এক এক করে ছুটি নিতে গেলাম। ইতি আর জুঁইয়ের ছুটি মঞ্জুর হলো; কিন্তু আমি ছুটি পেলাম না। পেটব্যথার অভিনয়টা হয়তো হয়নি।
মাঠের পাশে টিফিন টাইমে ঝালমুড়ি আর ফুচকার দোকান বসে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন আজিজ ভাই, টিফিন টাইমে কেউ পালায় কি না নজরদারির জন্য। শিল্পী মাসি টিফিনের ঘণ্টা বাজাতেই আমি এক দৌড়ে স্কুলের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকলাম। ওরা দুজন স্যারের স্বাক্ষর দেওয়া কাগজ দেখিয়ে দেওয়ায় আজিজ ভাই তাদের যেতে দিলেন। আমি তখন সাহস করে, অনেক ঝুঁকি নিয়ে স্কুলের পেছন দিকের নদী ঘেঁষে চুপি চুপি বেরিয়ে এলাম।
দুই পাশে সাঁকো দেওয়া নদীটা পার হয়ে গ্রামে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি, তারা দুজন আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কীভাবে স্কুল থেকে বের হয়ে এলাম, তার বিবরণ দিতে দিতে আমরা গ্রামের ছোট রাস্তা ধরে চললাম। হঠাৎ ইতি বলল, সে টাকা আনতে ভুলে গেছে। আমরা বললাম, আমাদের কাছে যথেষ্ট আছে, যা খুশি কিনতে পারবে। কী কিনব, কী খাব ইত্যাদি পরিকল্পনা করতে করতে মেলার মাঠের খুব কাছে যখন চলে এলাম, তখন দেখি, না আছে মেলা, না আছেন সেই সন্ন্যাসী; যাঁর অসাধারণ সব জাদু দেখতে আমাদের আসা।
সব বৃথা গেল। মেলার মাঠে পড়ে থাকা ঝালমুড়ি-চানাচুরের প্যাকেটগুলো যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে দেখি কী কাণ্ড। তারাও মুখ টিপে হাসছে।
মেলা সকালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই আর দেখা হয়নি। যদিও পরেরবার ওই মেলা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে; কিন্তু এর জন্য স্কুল পালাতে হয়নি।
সানজিদা পাঠান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়