ফিরে দেখা
জিয়া হত্যা, মন্ত্রীর বাড়িতে সন্ত্রাসী ও এরশাদের ক্ষমতা দখল
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, দিনটি ছিল বুধবার। সেটি ছিল রক্তপাতহীন একটি অভ্যুত্থান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেন জেনারেল এরশাদ।
৪৩ বছর আগে এই দিনে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন জেনারেল এরশাদ। কী ছিল সামরিক শাসন জারির প্রেক্ষাপট। আর সেই প্রেক্ষাপটটি তৈরি হয়েছিল কীভাবে—তারই বিবরণ এই প্রতিবেদনে
মন্ত্রীর বাড়ি থেকে সন্ত্রাসী ইমদু গ্রেপ্তার
১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। তখন ক্ষমতায় বিএনপি সরকার। ওই দিন যুব প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসা থেকে আটক করা হয় কুখ্যাত সন্ত্রাসী ইমদাদুল হক ইমদুকে। মিন্টো রোডের মন্ত্রীর বাসা থেকে ইমদুকে আটক করা হয়েছিল বিশাল আয়োজন করে। রীতিমতো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। কালীগঞ্জের ইমদু যুবদল করতেন। তিনি যখন মন্ত্রীর বাড়ি থেকে আটক হন, তখন নতুন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সেই ঘটনার তিন দিন পরে ১১ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে পুরো মন্ত্রিসভা বাতিল করেন তিনি। এর প্রায় দেড় মাসের মধ্যে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন জেনারেল এরশাদ।
২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে এরশাদ জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় ইমদুর ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সীমাহীন দুর্নীতির ফলে দেশে এমন এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী তাহার সরকারি বাসভবনে একজন ঘৃণ্য খুনি আসামিকে আশ্রয়দান করিতে দ্বিধাবোধ করে নাই। আপনারা জানিয়া বিস্মিত হইবেন যে, এই ন্যক্কারজনক ঘটনা যাহাতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হয়, সে জন্য সরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ সেদিন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু আমাদের নির্ভীক-সত্যনিষ্ঠ, সাংবাদিকগণ সেই কুচক্রী মহলের কাছে নতি স্বীকার না করিয়া সাংবাদিকতার মহান আদর্শ সমুন্নত রাখিতে সমর্থ হন। যাহার ফলে এই দুর্নীতিবাজ সরকারের মুখোশ খুলিয়া পড়ে জনগণের সম্মুখে এবং তাহারই ফলশ্রুতিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার বাধ্য হন।’
প্রয়াত রাজনীতিবিদ মওদুদ আহমদ ‘চলমান ইতিহাস’ বইয়ে ইমদু আটকের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, ‘সাত্তারের মন্ত্রিসভার দুটি গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করে। জামালউদ্দিন আর হাসনাতকে টার্গেট করা হলো—দেশের মধ্যে যেন শুধু তারাই দুর্নীতিবাজ। একই চক্রান্তের ফলে আবুল কাশেমের বাড়ি থেকে খুনের আসামি ইমদাদুল হক ইমদুকে পাওয়া গেল। সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করাই হলো মূল লক্ষ্য। একজন পলাতক আসামিকে ধরার জন্য এক মন্ত্রীর বাড়িতে একই মন্ত্রিসভার আরেকজন মন্ত্রী ঢাকঢোল পিটিয়ে পুলিশ পাঠান। সে এক অসম্ভব কাণ্ড। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মতিনের সঙ্গে কাশেমের মনোমালিন্য ছিল, তাই তার প্রতিশোধ নেওয়া হলো এইভাবে। দেশের বা দলের বা সরকারের স্বার্থটা একবারও ভেবে দেখা হলো না। লোকশ্রুতি অনুযায়ী মতিন ছিলেন শাহ আজিজের গ্রুপের সদস্য, আর কাশেম ছিলেন জামালউদ্দিন-হাসনাত গ্রুপের।
ইমদুর ঘটনা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপানো হয়। রং চড়িয়ে একে একটি রীতিমতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। সরকারবিরোধী এবং সামরিক বাহিনীর সমর্থক শক্তিগুলো এ ঘটনাকে আরও নাটকীয় করার চেষ্টা করে। ঘটনাটি সরকারের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং অক্ষমতাকে আরও প্রকটভাবে জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করে। যেকোনো কারণের জন্য হোক বা যে ষড়যন্ত্রের জন্যই হোক, ব্যাপারটিকে ফলাও করে প্রচার করার ফলে জনসমক্ষে সরকার হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং সুনামহানি ঘটে। এ ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসাররা যেন এ রকমই একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এই ঘটনায় দেশ পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ভূমিকার প্রয়োজনটা যেন আরও প্রকট আকার ধারণ করল। ঘটনাটি একটি রহস্যে ঢাকা থাকে। অনেকের মতে ইমদুকে কাশেমের বাড়িতে একটি বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগের পরামর্শে প্ল্যান্ট করা হয়েছিল এবং পুরো ব্যাপারটি ছিল একটি ষড়যন্ত্রমূলক সাজানো ঘটনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না বুঝে শুধু কাশেমের ওপর তাঁর ক্ষোভ মেটানোর জন্য ও ধরনের একটি কাজে জড়ায়নি।’
মওদুদ আহমদ আরও লিখেছেন, ‘ইমদু এবং কাশেমের ঘটনার পর ১১ ফেব্রুয়ারি কিছু সিনিয়র সেনা অফিসার দুপুর দুটোর দিকে বঙ্গভবনে যান। তাঁরা প্রেসিডেন্টের কাছে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং প্রেসিডেন্ট যাতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন, সে জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। ক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে তাঁরা সেদিন বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন এবং যতটুকু চাপ সৃষ্টি করার দরকার, তা করেছিলেন। তাঁরা প্রেসিডেন্টকে প্রথমে অনুরোধ এবং পরে বেশ রূঢ় ভাষায় ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত সাত্তার তাঁর “অদক্ষ এবং দুর্নীতিপরায়ণ” মন্ত্রিসভা বাতিল করতে রাজি হলেও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হননি। সামরিক অফিসাররা একটি মিশ্র মনোভাব নিয়ে ব্যারাকে ফিরে যান।’
সেদিন ফিরে গেলেও এর কিছুদিন পরে, ঠিকই সামরিক শাসন জারি করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তবে ইমদু একটি উপলক্ষ্য হলেও এরশাদ ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করেছিলেন আরও আগে থেকেই। বলা যায় ৯ মাস ধরেই ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি ও প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন এই সাবেক সামরিক শাসক। হঠাৎ বা গোপনে সেই অভ্যুত্থান করেননি।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, দিনটি ছিল বুধবার। সেটি ছিল রক্তপাতহীন একটি অভ্যুত্থান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেন জেনারেল এরশাদ। তিনি সামরিক ফরমান জারি করার পর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং স্থগিত করেন সংবিধানের কার্যকারিতা।
প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যা ও এরশাদের প্রস্তুতি পর্ব
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এই ঘটনার পর বিএনপি সরকার ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়, দলের ভেতরে উপদলীয় কোন্দল ছিল প্রকট। চট্টগ্রাম বিএনপির বিরোধ মেটাতেই জিয়া ২৯ মে সেখানে গিয়েছিলেন।
জিয়া হত্যার পর এরশাদের মনোভাব জানা যায় অবসরপ্রাপ্ত মে. জে. মইনুল হোসেন চৌধুরীর লেখায়। সেনা সদর দপ্তরে তিনি এরশাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘এখন কী হবে।’ এরশাদ সরাসরি কিছু না বললেও সামরিক আইন জারিরই ইঙ্গিত দিলেন। ‘...বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কলহ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এই সুযোগে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পথও সহজ হয়ে উঠেছিল। বিএনপির অনেক নেতা, মন্ত্রী ও কয়েকজন সচিব গোপনে এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।’ (এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য)
জিয়া হত্যার পরপরই এরশাদ ক্ষমতা দখল করেননি সেনাবাহিনীর ভেতরে ও সাধারণ মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের প্রতি সমর্থন জানান। জিয়া-মঞ্জুর হত্যার ব্যাপারে এরশাদের প্রতি যে সন্দেহের তির ছিল, তা থেকেও তিনি নিজেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকেন। জিয়া হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণকারী জেনারেল মঞ্জুরকেও পরে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে হত্যা করা হয়; ফলে জিয়া হত্যার সঙ্গে মঞ্জুরের সম্পৃক্ততা ছিল কি ছিল না, তা কখনো জানা যাবে না।
কয়েক মাস আগে থেকেই এরশাদ সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে একটি কথা বেশ জোরেশোরে প্রচার করতে থাকেন যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রথাগত বাহিনী নয়। রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি তাদের দেশ পরিচালনায় ভূমিকা রাখারও সুযোগ দিতে হবে। তিনি সামরিক জার্নালে ‘রোল অব মিলিটারি ইন ডেভেলপিং কান্ট্রি’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন।
জিয়া হত্যার দায়ে যাঁরা বিচারের মুখোমুখি হলেন, তাঁরা প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা। এর আগে যতগুলো বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান হয়েছে, সব কটির সঙ্গে মূলত মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। এরশাদ এই সুযোগে সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্মকর্তাদের আনার ব্যবস্থা করেন; তিনি নিজেও একজন পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্মকর্তা। অন্যদিকে বিএনপিতেও তখন মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা শিবির প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল।
প্রার্থী মনোনয়নে হস্তক্ষেপ
সেনাপ্রধান হয়েও এরশাদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে ‘হস্তক্ষেপ’ করেন। বিএনপির একাংশ চাইছিল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া প্রার্থী হোন। অপরাংশ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের সমর্থক ছিল। এ প্রসঙ্গে জিয়ার এককালীন মন্ত্রী ও দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের প্রভাবশালী সদস্য মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘সাত্তারের প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থনের কারণে তাঁদের (সাত্তারের অনুসারীদের) পক্ষে ওই একগুঁয়ে মানসিকতা ও শক্তি প্রদর্শন সম্ভব হয়।’ (চলমান ইতিহাস, জীবনের কিছু সময়, কিছু কথা)
মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর মওদুদ আহমদ বিএনপির ‘বিদ্রোহী গ্রুপের’ নেতা হন। বিএনপির ৯০ জন সংসদ সদস্য তাঁর প্রতি আস্থাশীল ছিলেন বলে নিজের বইয়ে উল্লেখ করেছেন। মওদুদ যখন খালেদা জিয়ার মনোনয়নের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলেন, তখন এরশাদ বঙ্গভবনে চারজনের একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন; যাঁদের মধ্যে ছিলেন এরশাদ নিজে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার, প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও মওদুদ আহমদ।
মওদুদ লিখেছেন, ‘নির্বাচনে সাত্তারের জয় সুনিশ্চিত করার বিষয়ে জেনারেল এরশাদ এবং তাঁর সহকর্মীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ ব্যাপারে কোনোরকম গোলযোগ বা বাধা বা জটিলতা সৃষ্টি হোক, তাঁরা সেটা চাননি। কোনোরকম ঝুঁকি নিতে তাঁরা রাজি ছিলেন না।...এরশাদ একদিকে যেমন সাত্তারের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, অন্যদিকে বিএনপির ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও কলহ যেন চলতে থাকে, সেটাও চেয়েছেন।’ (চলমান ইতিহাস, জীবনের কিছু সময়, কিছু কথা)
১৯৮১ সালের ১৮ অক্টোবর সাপ্তাহিক হলি ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়ে এরশাদ আওয়ামী লীগ ও জেনারেল ওসমানীকে নাকচ করে দেন এবং বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিএনপির কোনো বিকল্প নেই।
এরশাদ এসব কথা বলেছেন বিএনপির প্রতি কোনো দরদ থেকে নয়। তিনি জানেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হলে তিনি তাঁদের বাগে আনতে পারবেন না। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার জয়ী হলে তাঁকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারবেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সেদিকেই চালিত হয়।
সাংবিধানিক ভূমিকার দাবি
১৯৮১ সালের ১১ অক্টোবর লন্ডনের গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এরশাদ বলেছিলেন, দেশে ভবিষ্যতে যাতে সেনা অভ্যুত্থান ঘটতে না পারে, সে জন্য সামরিক বাহিনীকে সরাসরি দেশের প্রশাসনে জড়িত রাখতে হবে। সেনাবাহিনীর এই ভূমিকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনারও প্রস্তাব দেন তিনি। ২০ নভেম্বর যে দিন বিচারপতি সাত্তার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন, সে দিনই এরশাদ বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিয়ে দেশ শাসনে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা পুনরুল্লেখ করেন।
প্রকাশ্যে এসব ঘটনার বাইরে ক্ষমতার অন্দরমহলে নানা তৎপরতা চলছিল। বিএনপির নেতৃত্বের বিভক্ত গ্রুপগুলো একে অপরকে ঘায়েল করতে সেনাপ্রধানের সমর্থন চায়। সেনাপ্রধানও এক গ্রুপকে অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন।
সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক
১৯৮১ সালের ২৮ নভেম্বর সেনাপ্রধান এরশাদ ঢাকার কয়েকটি পত্রিকা ও বার্তা সংস্থার সম্পাদককে তাঁর অফিসে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে তিনি একটি লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান এবং তার কপি সম্পাদকদের হাতে দেন। পরদিন সংবাদ শিরোনাম করে: ‘ক্ষমতার ভাগ নয়, সেনাবাহিনী গণতন্ত্র নির্মাণে সাহায্য করতে চায়’। ইত্তেফাক-এর শিরোনাম ছিল: ‘গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামোর মধ্যেও জাতি গঠনমূলক কাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকিতে পারে’।
এরশাদের বিবৃতির মূল কথা ছিল: ‘নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কীভাবে সেনাবাহিনী দেশ গঠনে তাহার ভূমিকা রাখিতে পারেন, সেই বিষয়টি সকলকেই খুঁজিয়া দেখিতে হইবে। নিজের কোনো ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ পূরণের উদ্দেশ্য নয় বরং অতীতের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার নিরিখেই তিনি এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।...অনুগ্রহপূর্বক সশস্ত্র বাহিনীর উপর পূর্ণ আস্থা রাখুন।
তাহাদিগকে এই উপলব্ধি দিন যে তাহারাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এভাবে হঠকারিতা রোধে সৈনিকদের সহায়তা করিতে জনগণকে সুযোগ দিন। বিশ্বের অনেক দেশের সংবিধানেই এমন সাংবিধানিক মর্যাদা নিশ্চিত করা আছে। (ইত্তেফাক, ২৯ নভেম্বর, ১৯৮১)
গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো
সেনাপ্রধান এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা বিএনপি সরকারকে জনসমক্ষে হেয় করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় অভিন্ন শিরোনামে খবর বের হয়: ‘১৬ মন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত চলছে এবং বিচারপতি সাত্তার এই নির্দেশ দিয়েছেন’।
মওদুদ লিখেছেন, বিচারপতি সাত্তারের মন্ত্রিসভা আগে থেকে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল নীতিগত কারণে নয়, ব্যক্তিস্বার্থে। এদের মধ্যে একটি দল সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে, যাতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করলেও তাদের মন্ত্রিত্ব থাকে। এ সময় বঙ্গভবনে কী কী কথা হতো, তা-ও সেনাপ্রধানের কাছে চলে যেত।
জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ
এরশাদের প্রস্তাব অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হয়। বিচারপতি সাত্তার চেয়েছিলেন ১০ সদস্যের পরিষদে বেসামরিক প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবেন। কিন্তু সেনাপ্রধান সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এরপর ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয় রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও তিন বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে।
এরই মধ্যে একটি ঘটনা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাড়ি থেকে খুনের মামলার আসামি ইমদাদুল হক ওরফে ইমদুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ইমদু একসময় আওয়ামী লীগ করতেন, পরে জাসদ হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন।
এরপর সরকারের ওপর সেনা নেতৃত্বের চাপ আরও বাড়তে থাকে। মওদুদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইমদুর ঘটনার পরদিন কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা বঙ্গভবনে যান এবং সাত্তারকে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়তে চাপ দেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ মন্ত্রিসভা বাতিল করতে রাজি হলেও সে দিন ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান।
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চোখে
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লরেন্স জিরিং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ: ফ্রম মুজিব টু এরশাদ, অ্যান ইন্টারপেরেটিভ স্টাডি বইয়ে লিখেছেন: বিচারপতি সাত্তার এরশাদের হস্তক্ষেপ ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পেরে ব্যর্থ হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্লান্ত ও তুলনামূলক ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবন ত্যাগ করেন এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন এরশাদ।
অবশ্য এরশাদ তাঁর নিজের বই আমার কর্ম ও জীবন-এ ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর দাবি, ‘দেশ যখন চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি, তখন দলীয় নেতাদের অন্যায় আচরণ সমর্থন না করে বিজ্ঞ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার আমাকে ডেকে পাঠালেন। দেশের সংকটময় মুহূর্তে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে আমাকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিতে নির্দেশ দিলেন।’
কূটনৈতিক যোগাযোগ
ক্ষমতারোহণের আগে থেকে এরশাদ প্রভাবশালী ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ যথা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও ভারতের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। সংশ্লিষ্ট দেশের ঢাকায় কর্মরত রাষ্ট্রদূতদের ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনার কথাও জানানো হয়েছিল।
বাংলাদেশে এর আগের অভ্যুত্থানগুলো ছিল রক্তাক্ত ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চের অভ্যুত্থান ছিল রক্তপাতহীন। এরশাদের ৯ বছরের শাসনে সেনাবাহিনীতে কোনো অভ্যুত্থানের ঘটনার কথা জানা যায় না। তিনি যাঁকেই প্রতিপক্ষ মনে করেছেন, তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় দিয়েছেন। তাঁর শাসনের প্রায় পুরোটা সময় ছিল ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ও আন্দোলনমুখর। নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মুখেই এই সেনাশাসককে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়।
(প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুটি লেখার সমন্বয়ে এই লেখা তৈরি করা হয়েছে। যেমন মন্ত্রীর বাড়িতে খুনি: যে ঘটনা ছিল এরশাদের সামরিক শাসনের উপলক্ষ, শওকত হোসেন, ২৪ মার্চ, ২০২৩ এবং ক্ষমতা দখলের আগেই ‘ক্ষমতার স্বাদ’ নেন এরশাদ, সোহরাব হাসান, ২৪ মার্চ, ২০২৩।)