সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ: হয়রানিমূলক ধারা বাদ নতুন খসড়ায়
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের নতুন একটি খসড়ায় সাইবার বুলিং–সংক্রান্ত অপরাধের ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। এই ধারা অন্তর্বর্তী সরকারের সময় যোগ করা হয়েছিল, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
নতুন সরকার যে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া করেছে, সেখানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ছিল ব্যাপক বিতর্কিত, যেগুলো ব্যবহার করে হয়রানি করা হতো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিতর্কিত ধারা বাদ দেওয়ায় মতপ্রকাশের কারণে হয়রানির সুযোগ কমবে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫ নিয়ে গতকাল বুধবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাদেশের খসড়ার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। এতে জানানো হয়, খসড়া গতকাল ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অংশীজনদের মতামত নেওয়া হবে। এরপর এটি নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনার পর আইনের খসড়াটি অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হবে।
৯টি ধারা বাদ দেওয়ার ফলে ওই ধারাগুলোর অধীন থাকা ৯০-৯৫ শতাংশ মামলা খারিজ হবে। বর্তমান সরকার নিবর্তনমূলক কোনো আইন চায় না।ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, নীতি পরামর্শক, আইসিটি বিভাগ
বিভিন্ন পক্ষের মতামত আমলে নিয়ে অধ্যাদেশের খসড়া তৈরির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার তড়িঘড়ি করার প্রবণতা থেকে সরে এসেছে, এটা ইতিবাচক। তবে আইনটি নিয়ে আরও পর্যালোচনা করে আমরা মতামত জানাব।’
উপদেষ্টা পরিষদে গত ২৪ ডিসেম্বর সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অনুমোদিত খসড়াটি নিয়ে সমালোচনা হয়। সেখানে ধারা ২৫-এ সাইবার বুলিংয়ের নামে একটি বিধান ছিল। ওই ধারায় বলা হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদান প্ল্যাটফর্ম, ওয়েবসাইট বা সাইবার স্পেসে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, হুমকি প্রদান বা হয়রানি করা, মিথ্যা বা ক্ষতিকর তথ্য, অপমানজনক বার্তা, গালিগালাজ, গুজব বা মানহানিকর আধেয় (কনটেন্ট) ছড়ানোর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির সুনাম বা মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।
সমালোচনার মুখে নতুন করে আইনটির খসড়া করা হয়। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, অংশীজনদের মতামত নিয়ে খসড়া চূড়ান্ত করতে ছয় সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে অধ্যাদেশটির খসড়া হয়। এরপর টিআইবি, বিভিন্ন গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে মতামত নেওয়া হয়। তা বিশ্লেষণ ও আইন বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী অধ্যাদেশের খসড়া হালনাগাদ করা হয়েছে। নতুন খসড়া নিয়ে আবার আলোচনা হবে।
বিতর্কিত আইন: তখন, এখন
ডিজিটাল জগতে অপরাধ দমনের জন্য আইনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৬ সালে। ওই বছর তথ্যপ্রযুক্তি আইন করা হয়। তবে এই আইনের ৫৭ নম্বর ধারাটি ছিল চরম বিতর্কিত। সেখানে মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে—এমন সব বিষয়ে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান করা হয়। সমস্যা হলো, আইনে অপরাধের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ছিল না। ফলে মানুষকে হয়রানির ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়।
সমালোচনার মুখে সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপরাধকে বিভিন্ন ধারায় ভাগ করে রেখে দেওয়া হয় এবং এর রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়। ২০২৩ সালের জুনে সংসদে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের পর এ আইনে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজার ১টি মামলা করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ২০২৪ সালের এপ্রিলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ৪৩৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে জানায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনীতিবিদ (৩২ শতাংশ) ও সাংবাদিকই (২৯ শতাংশ) বেশি। মামলা বেশি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সিজিএস জানিয়েছিল, অভিযোগকারীর প্রায় ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
দেশের ভেতরে সমালোচনা ও আন্দোলন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার আপত্তির মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সাইবার নিরাপত্তা আইন করে। যদিও নতুন আইনে বিতর্কিত ধারা রেখে দেওয়া হয়। শুধু সাজা কিছুটা কমানো হয় এবং কিছু ধারা জামিনযোগ্য করা হয়। এ নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের ঘোষণা দেয়। করা হয় সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া।
বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান আইসিটি সচিব। ধারাগুলো হলো ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩৪। এর মধ্যে চারটি ধারা বেশি বিতর্কিত ছিল। সেগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড (২১); পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ; আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শন, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ (২৫); মানহানিকর তথ্য প্রকাশ (২৯); আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ডের (৩১) কথা বলা হয়েছিল। এসব ধারা বাতিল হয়েছে।
২৪ নম্বর ধারায় পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণসংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছিল। নতুন খসড়ায় ২৩ নম্বর ধারায় আংশিকভাবে এসব অপরাধের কথা বলা হয়েছে। ২৬ নম্বর ধারায় অনুমতি ব্যতীত তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। কাছাকাছি ধরনের অপরাধের শাস্তির কথা বলা হয়েছে নতুন খসড়ার ২২ ধারায়। ২৭ নম্বর ধারায় সাইবার সন্ত্রাসের অপরাধের কথা বলা হয়েছিল। সেটা নতুন খসড়ায় ২৩ নম্বর ধারায় রাখা হয়েছে। ২৮ নম্বর ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তির কথা বলা হয়েছিল। নতুন অধ্যাদেশের খসড়ার ২৬ নম্বর ধারায় সাইবার স্পেসে ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশ করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। ৩৪ নম্বর ধারায় মিথ্যা মামলা করা হলে শাস্তির বিষয়ে বলা ছিল। নতুন আইনে তা ২৮ নম্বর ধারায় আছে।
টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ধর্মীয়, জাতিগত বিদ্বেষ–বিষয়ক সংক্রান্ত বিধান যদি রাখতেই হয়, তবে সমাজে আরও অনেক বৈচিত্র্যের মানুষ রয়েছে, তাদের প্রতি বিদ্বেষ প্রসঙ্গ আসতে পারে। তবে এ ধরনের বিধান রাখতে হলে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। নয়তো অপব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে।
বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের সুযোগ সীমিত
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে জাতীয় পতাকা ও সংগীতের অবমাননার শাস্তির বিধান ছিল, কিন্তু অনুমোদিত খসড়ায় তা বাদ পড়ে। পরবর্তী সময়ে আরেকটি খসড়ায় তা যুক্ত করা হয়। সর্বশেষ প্রকাশিত খসড়ায় তা আবার বাদ দেওয়া হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে এবং অনুমোদিত খসড়ায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের বিধান ছিল। সর্বশেষ খসড়ায় শুধু বেআইনি প্রবেশ বা হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের বিধান রাখা হয়েছে।
নতুন অধ্যাদেশের খসড়ার ৮ ধারায় আগের মতো বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) আধেয় ব্লকের (প্রচার আটকে দেওয়া) অনুরোধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে স্বচ্ছতার স্বার্থে কী কী আধেয় ব্লক হয়েছে, তা প্রকাশ করার বিধান নতুন করে যুক্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাদেশটিতে সাইবার নিরাপত্তা, কনটেন্ট মডারেশন (আধেয় সংযত করা) ও সাইবার অপরাধ দমনের বিষয়কে আলাদা করা হয়নি। ফলে অধ্যাদেশটি কতটা উপযোগী ও নাগরিকবান্ধব হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে খসড়া অধ্যাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো নিপীড়নমূলক ধারা নেই বলে তা নাগরিকদের জন্য ক্ষতিকর হবে না।
‘৯০-৯৫% মামলা খারিজ হবে’
আইসিটি বিভাগের সংবাদ সম্মেলনে শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, অধ্যাদেশটির দ্বারা যেন মানুষ নিগ্রহের শিকার না হন এবং নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সে চেষ্টা করা হচ্ছে।
আইসিটি বিভাগের নীতি পরামর্শক (সমন্বয় ও সংস্কার) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিতর্কিত ৯টি ধারা বাদ দেওয়ার ফলে ওই ধারাগুলোর অধীন থাকা ৯০-৯৫ শতাংশ মামলা খারিজ হবে। বর্তমান সরকার নিবর্তনমূলক কোনো আইন চায় না।
জানতে চাইলে ফয়েজ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাদেশটি কারিগরি দিক ও সংজ্ঞার দিক থেকে সমৃদ্ধ, মানবিক ও নাগরিকবান্ধব। এখানে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইবার সুরক্ষার বিধান রয়েছে। এটা নাগরিকদের মতপ্রকাশে বাধা দেবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সরকার যদি কারসাজি না করে, তাহলে এই অধ্যাদেশ সাইবার জগতে নাগরিকদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেবে। আইন যতটা সঠিক হোক না কেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি সভ্য সংস্কৃতির চর্চা না থাকে, তাহলে যেকোনো আইনেরই অপব্যবহার সম্ভব।