হলুদ পলাশের পদাবলি
এক বসন্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়েছিলাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুরে লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের ভেতরে একটি রোপিত বৃক্ষের পলাশবাগান দর্শনের সুযোগ হয়েছিল। এক জায়গায় ১৭টা পলাশের গাছ ছিল। এর মধ্যে একটা গাছের ফুল আমাকে বিস্মিত করে। কেননা এর আগে কখনো হলুদ রঙের পলাশ ফুল দেখিনি। সব গাছের পলাশ ফুলগুলো লাল, শুধু ওই একটা গাছের ফুলের রং ছিল হলুদ। তার ছবিও তুলেছিলাম। খোঁজাখুঁজির পর সে ছবিটাকে পেয়ে হলুদ পলাশ নিয়ে লিখলাম এ কারণে যে খোঁজ নিয়ে জানলাম, দুষ্প্রাপ্য সেই হলুদ পলাশের গাছটা মরে গেছে। ওই দুর্লভ গাছটার কোনো বংশধর থাকল না! কয়েক বছর হলুদ পলাশের সন্ধান করলাম দেশের কিছু জায়গায়। কিন্তু খোঁজ না পেয়ে হতাশায় মনটা ভারী হয়ে উঠল। অবশেষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান যখন জানালেন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে তিনি হলুদ পলাশ ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন, সেসব গাছে ফুল ফুটেছে। ফুল ফোটা সে গাছের ছবি তুলেও তিনি আমাকে পাঠালেন। মনটা আনন্দে ভরে উঠল, হলুদ পলাশ তাহলে দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। আরণ্যক উপন্যাসের যুগলপ্রসাদের মতো আমাদেরও একজন আছেন, যিনি দেশের নানা প্রান্ত থেকে দুর্লভ গাছ সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
দেশ থেকে পলাশই তো ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এখন আর সহজে দেখা মেলে না অরণ্যের অগ্নিশিখা পলাশ ফুলের। যা দু–চারটা আছে, নগরের উদ্যানে আর যমুনা সেতু পেরোনোর আগে। তুলনামূলকভাবে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র মাটির বনে পলাশের গাছ বেশি চোখে পড়ে।
লাল পলাশের চেয়ে হলুদ পলাশ ফোটে কম। হলুদ পলাশের ফুল ফোটার কালও তুলনামূলকভাবে কম। গাছে খুব অল্প দিনের জন্যই হলুদ পলাশকে দেখা যায়। হলুদ ও লাল পলাশের গোত্র, পরিবার, প্রজাতি একই। গাছের চেহারাও অভিন্ন। পার্থক্যটা শুধু ফুলের রঙে। পলাশের দুটি প্রজাতি রয়েছে—বিউটিয়া মনোসপারমা ও বিউটিয়া সুপারবা এবং পরিবার ফ্যাবেসি। লাল ও হলুদ পলাশ দুটিই প্রথমোক্ত প্রজাতির, এসব পলাশগাছ বৃক্ষÿ প্রকৃতির। পলাশের অন্য নাম কিংশুক, কিনাকা ও ঢাক। বিউটিয়া সুপারবা প্রজাতির গাছ লতানো স্বভাবের। একে বলে পলাশ লতা বা লতাপলাশ, এর ফুল লাল। এ জন্য এর আরেক নাম লাল পলাশ।
হলুদ পলাশগাছ প্রায় ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতাঝরা স্বভাবের, শীতে প্রায় সব পাতা ঝরে যায়। বাকল বেশ পুরু, হালকা বাদামি বা ধূসর রঙের। তিনটি পাতা একটি বোঁটায় থাকে। কচি পাতা হালকা মখমলের মতো, কিন্তু বয়স্ক পাতা মসৃণ। পাতা চামড়ার মতো। ফুল প্রশাখার ওপরে ফোটে থোকা ধরে। ফুল ফোটে ফেব্রুয়ারি-মার্চে। ফুল প্রায় ৫ সেন্টিমিটার লম্বা, কাস্তের মতো বাঁকানো, অগ্রভাগ সুচালো। পাপড়ি মখমলের মতো নরম। ফল শিমের মতো। ফল পাকে এপ্রিলে।
হলুদ পলাশের জন্ম ভারতবর্ষেই। গাছ খুব কষ্ট সইতে পারে। লোনা, শুষ্ক ও রুক্ষ মাটিতেও পলাশ একপ্রকার বিনা যত্নেই ফুল দেয়। ফুল ফোটার সময় সাধারণত গাছে কোনো পাতা থাকে না। বীজ দিয়ে গাছটির নতুন চারা তৈরি করা যায়। হলুদ পলাশের গাছ এ দেশে দুর্লভ, তাই গাছটি থেকে বীজ সংগ্রহ করে তার চারা তৈরি ও দেশের বিভিন্ন উদ্যানে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।