প্রকৃতির নিয়মেই রাত হয়, রাত শেষে ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ধরিত্রীর অর্ধেকটা। ঘুম শেষে আমরা যেমন জাগার আগে আড়মোড়া ভাঙি, গাছেরাও তেমনি। কোনো কোনো গাছ তো তাদের পাতাগুলো রাতে ভাঁজ করে বিশ্রামে যায়, আবার সূর্যের আলোয় পাতা মেলে সৌরালোককে বরণ করে নেয়, তাপিত হয় নিজেদের শক্তি উত্পাদনের জন্য। আর সেই শক্তি খরচ করে তারা পৃথিবীর বুকে ফুল ফোটায়।
সেসব ফুল আমন্ত্রণ জানায় পতঙ্গকুলকে। রেণুখেলায় মেতে ওঠে মৌমাছিরা। বলধায় একটা ছোট্ট জলাশয়ের পাশে শ্রাবণের শেষে এক ভোরে বসে প্রকৃতির এসব রহস্যের খেলা দেখছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। বেলা বাড়ছে, আর ফুলের পাপড়ি খুলছে একটার পর একটা। কিন্তু আমার আর তর সইল না। পাপড়িগুলো পুরোপুরি খোলার আগেই সে ফুলের ছবি তুলে ফেললাম।
আগের দিন যখন এসেছিলাম, তখন গাছটার বড় একটা কুঁড়ি দেখেছিলাম। লালচে বাদামি বৃতির মোড়কে ঢাকা। বৃতির আবরু খুলে ফুলদলেরা পৃথিবীর আলো দেখার জন্য যেন অধীর হয়ে আছে। পানির মধ্যে ডুবে ছিল কুঁড়ির গোড়াটা। মালিরা বলেছিলেন, কাল সকাল আটটার মধ্যে এলে ফুলটা দেখা যাবে। মালিদের কথামতো ভোরবেলায় সেখানে গিয়ে বসে আছি। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও সে ফুলের পূর্ণ প্রস্ফুটন দেখতে না পারার আক্ষেপে পুড়তে হলো। তবু নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো দুর্লভ আমাজন লিলি ফুলটা দেখতে পেয়ে।
বরিশালের নিসর্গী ও চক্ষুচিকিত্সক ডা. এম আহমেদ বলধা গার্ডেনের একজন অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন, বন্ধু ছিলেন বলধা গার্ডেনের তত্কালীন সুপারভাইজার অমৃতলাল আচার্যবাবুরও। মাঝেমধ্যেই তিনি বরিশাল থেকে ঢাকায় বলধা গার্ডেনে আসতেন, অমৃতবাবুর সঙ্গে গল্প করতেন, গাছপালা দেখতেন। ডা. এম আহমেদ আমাদের দেশে অনেক চেষ্টার পর পঞ্চাশের দশকের শেষে এসে আমাজন লিলি চাষে সফল হন। সেখান থেকে তিনি বলধা গার্ডেনে আমাজন লিলির কয়েকটি চারা উপহার দেন। বলধা গার্ডেনের শঙ্খনাদ পুকুরে সেসব চারা লাগানো হয়। প্রায় ২৭ বছর আগে পল্টনে সংবাদ পত্রিকার অফিসে বসে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার কাছে আমাজন লিলির সেই ইতিহাস শুনেছিলাম। তখন সংবাদ-এর বিজ্ঞান পাতায় আমাজন লিলি নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। প্রখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন সে পাতার দায়িত্বে ছিলেন। আমার সে লেখায় এ ইতিহাসের ঘাটতি ছিল, যা নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা পরে সংবাদ-এ আমাজন লিলি নিয়ে আর একটি লেখা লিখে পূরণ করে দিয়েছিলেন। এসব কথা তিনি তাঁর একটি নিবন্ধেও লিখে রেখে গেছেন।
বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশের মাঝখানে সেই শঙ্খনাদ পুকুরেই আমাজন লিলি প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায় ও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। থালার মতো পাতাগুলো এত বড় হয় যে তা দেখে বিস্ময় জাগে। কথিত যে পূর্ণ বিকশিত একটি পাতার ওপর একটি নবজাতক শিশুকে শুইয়ে দিলেও সে ডোবে না। কিন্তু শঙ্খনাদ পুকুরে আমাজন লিলি আর বাঁচেনি। শোনা যায় পুকুরে তেলাপিয়া মাছের উপদ্রব বাড়ায় সেসব মাছ আমাজন লিলি ও শাপলাগাছগুলোর ক্ষতি করেছিল। অবশ্য ইতিমধ্যে সেখান থেকে আমাজন লিলির অন্যত্র স্থানান্তর ঘটায় তারা এ দেশে বংশ রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এরপর ওই পুকুরে আর কখনো আমাজন লিলির দেখা মেলেনি। আমাজন লিলির জন্য বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশে একটি ও সিবিলি অংশে আরেকটি ছোট পাকা জলাশয় তৈরি করা হয়েছে। সেখানেই গাছগুলো এখন বেঁচে আছে। আমাজন লিলি আছে মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে গোলাপবাগানের মধ্যেও।
আমাজন লিলি দক্ষিণ আমেরিকার গাছ, পদ্মের মতো দেখতে। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Victoria amazonica ও পরিবার Nymphaeaceae. এই পরিবারে আমাজন লিলি হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুল। ১৮৩২ সালে প্রথম এ উদ্ভিদের বিবরণ তৈরি করা হলেও গাছটি পরিচিতি পেতে শুরু করে বিশ শতকে এসে। এ উদ্ভিদের বিশেষত্ব হলো এর বিশাল বৃত্তাকার পাতা, থালার মতো আকৃতিবিশিষ্ট সে পাতার ব্যাস ৩ মিটার পর্যন্ত হতে পারে, এ দেশে ১ মিটারের মতো হয়। পাতার কিনারা খাঁজকাটা। পাতার শিরাবিন্যাস স্পষ্ট, ওপরের পিঠের রং সবুজ, নিচের পিঠ তামাটে সবুজ ও জালিকাকার। পাতার নিচের পিঠ ছোট ছোট কাঁটায় ভরা। ফুলের বোঁটা ও পাতার বোঁটাও কাঁটায় ভরা। বেশি ফুল ফোটে মে-জুন মাসে, তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত কিছু ফুল ফুটতে থাকে। ফুলের অনেকগুলো পাপড়ি, রং সাদা। পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুলের ব্যাস ১০ থেকে ১৫ ইঞ্চি। ফুল পুরোপুরি ফোটে সন্ধ্যাবেলায়। ফুলের বর্ণে ও গন্ধে আকৃষ্ট হয় পোকামাকড় ও তারাই পরাগায়ন ঘটায়। পরাগায়নের পর ফুলের রং লালচে বা গোলাপি হয়ে যায়, ফোটার তিন দিন পর সব পাপড়ি ঝরে যায়। পরাগায়নের পর ফল হয় পানির নিচে। বীজ থেকে গাছ হয়, পানির নিচে গাছের মোথা বা কন্দ থেকে নতুন গাছ জন্মে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক