ঢাকা শহরের ওয়ারী এলাকায় অবস্থিত প্রাচীন উদ্যান বলধা গার্ডেন। ভাওয়াল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ১৯০৯ সালে এই বাগান ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সফরকালে ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে এই বাগান দেখতে এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বলধা গার্ডেন দেখে কবিগুরুর মন্তব্য ছিল, ‘নরেন, কালি কলম দিয়ে আমি সারা জীবন যা করেছি, তুমি গাছপালা দিয়ে তাই করে চলেছ।’
যেখানে বিরল উদ্ভিদের সন্ধান পেয়েছেন, হোক সে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে, অকাতর অর্থ ব্যয়ে তা সংগ্রহ করেছেন নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী।
চলতি বছরের ৩০ মে গিয়েছিলাম বলধা গার্ডেনে। বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশের প্রধান ফটক দিয়ে সোজা একটু এগিয়ে যেতেই হাতের ডান দিকে চোখে পড়ল ডাকুর ও লেমোনিয়ার।
ডাকুর
এটি গুল্মজাতীয় গাছ। ফুল নয়নতারার মতো। গাছটিই ডাকুর। স্নিগ্ধ ফুলটি নয়নতারার নিকট সম্পর্কীয়। সারা বছরই শাখার অগ্রভাগে থোকায় থোকায় ডাকুর ফুল ফোটে। অনেক ফুল একসঙ্গে দেখতে তারার মতো মনে হয়। এ ফুলের সৌন্দর্য অনন্য। ডাকুর চিরসবুজ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম কপসিয়া ফ্রুটিকোসা। এটি অ্যাপোসাইনেসি পরিবারের সদস্য। এই ফুল ইংরেজিতে সার্ব ভিনেকা, পিংক কপসিয়া এবং পিংক গার্ডেনিয়া নামে পরিচিত। ডাকুর মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের ফুল। ডাকুর ফুলের আরেক নাম কাঠ মালতী। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই গাছটিতে হালকা গোলাপি রঙের ফুল তারার মতো জ্বলজ্বল করে।
ঝোপজাতীয় এ গুল্মকে বাড়তে দিলে চার মিটারের মতো লম্বা হতে পারে। অবশ্য কেটে-ছেঁটে পছন্দমতো গাছের আকার দেওয়া যায়। ডাকুরের গাঢ় সবুজ পাতা চোখ বা নৌকা আকৃতির। পাতায় শিরাগুলো সহজেই নজরে পড়ে। ডিম্বাকার পাতার অগ্রভাগ এবং পেছনের দিকটা সুচালো। খুব শক্ত সে পাতা বের হয় জোড়ায় জোড়ায়। ফুলগুলো গুচ্ছবদ্ধ, হালকা গোলাপি বর্ণের। ফুলের পাপড়ি হয় পাঁচটি, তবে পাপড়ির গোড়ার দিকে গাঢ় গোলাপি। ফুলের পাঁচটি পাপড়ি সমানভাবে সাজানো। নবীন ফুল অনেকটা সাদাটে গোলাপি। আবার বাসি ফুল সাদা রং ধারণ করতে থাকে। তবে ফুলের কেন্দ্রে সব সময় গাঢ় গোলাপি রং থেকেই যায়। দেখতে অনেকটা নয়নতারা ফুলের মতো। নয়নতারা ফুলেরও একই রকম পাঁচটি পাপড়ির কেন্দ্রে অন্য একটি রং দেখা যায়। গাছে ফুল থাকে অনেক দিন।
বাংলাদেশের আবহাওয়া এই ফুল চাষের উপযোগী হলেও চাষ খুব বেশি হয়নি। সচরাচর সব বাগানে এটা দেখা যায় না। ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে এবং বলধা গার্ডেনে গেলেই এই ফুলের স্নিগ্ধ পরশ পেতে পারেন। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে ডাকুরগাছ রয়েছে।
লেমোনিয়া
এটি চকচকে ও গাঢ় সবুজ পাতার একটি গুল্মজাতীয় গাছ। এর রয়েছে উজ্জ্বল গোলাপি বর্ণের খুব আকর্ষণীয় ফুল। ফুলের একটি অদ্ভুত চ্যাপটা চেহারা আছে। এর পাঁচটি পাপড়ি রয়েছে, যেখানে চারটি নিচের দিকে এবং অন্যটি ওপরের দিকে। পাপড়ি প্রকৃতির যেকোনো সাধারণ ফুলের চেয়ে কিছুটা শক্ত। গাছটিই লেমোনিয়া বা লিমোনিয়া।
লেমোনিয়া আমাদের দেশি উদ্ভিদ নয়। এর আদিনিবাস কিউবা ও ব্রাজিল অঞ্চল। এটি একটি বিরল উদ্ভিদ। লেবুও এই উদ্ভিদ গোত্রের। লেমোনিয়া বড় গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এটি বাংলাদেশে একটি বিদেশি ফুল, তাই এর কোনো স্থানীয় নাম নেই। উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম রেভেনিয়া সেপকটাবেলিস, এটি রুটেসি পরিবারের উদ্ভিদ। ইংরেজিতে লেমোনিয়া, পিংক রেভেনিয়া, লিমোনিয়া ইত্যাদি নামে পরিচিত। এই উদ্ভিদের ফুলের কুঁড়িগুলোও দেখতে সুন্দর। পাতাগুলো গাঢ় সবুজ এবং চকচকে, উপবৃত্তাকার আকারের ৩টি পত্রকে বিভক্ত। প্রতিটি পত্রক ৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ঢাকার বলধা গার্ডেন ছাড়াও ময়মনসিংহের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার সামনে এবং বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের উদ্যানে এই উদ্ভিদ দেখেছি।
চয়ন বিকাশ ভদ্র, প্রকৃতিবিষয়ক লেখক