অস্তিত্বসংকটে মেছো বিড়াল
কার্নিভোর বা মাংসাশী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের পায়ের ছাপ চিনতে পারা তাদের জানার প্রথম শর্ত। জিম করবেট পড়ে জেনেছি। মুন্সিগঞ্জে পাখি দেখতে গিয়ে এই বিদ্যা কাজে এসেছিল। ২০২২ সালের শীতে পদ্মার নাম না–জানা চরে নেমেছিলাম। দুপুর গড়ালেও পাখির আশানুরূপ দেখা নেই। তাই চরের পাড় ঘেঁষে হাঁটছিলাম আর পায়ের ছাপ চেনার চেষ্টা করছিলাম।
এক পাশে পদ্মা, আরেক পাশে ঘন নলবন আর লম্বা ঘাসেদের সারি। নরম বালুতে চরের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের নানা চিহ্ন। এক পাশ দিয়ে শিয়াল হেঁটে গেছে। অন্য পাশ থেকে মেছো বিড়াল। একটু এগোতেই বনবিড়াল আর ভোঁদড়ের পায়ের ছাপও নজরে এল। সকাল সকাল জাল তুলতে হেঁটে যাওয়া মানুষের চিহ্নও রয়েছে। ইঁদুর আর পাখিদের চলাচলের প্রমাণ অগণিত। জোয়ার তখনো শুরু হয়নি। প্রতিটি পায়ের ছাপ তাই অত্যন্ত টাটকা, ছাপের কোনাগুলো স্পষ্ট। রাতে এই একফালি জায়গাটুকু বুনো প্রাণীদের এক ব্যস্ত সড়কে পরিণত হয়েছিল। ঢাকার কাছেই এ রকম জায়গা পাব ভাবিনি। বিশেষ করে মেছো বিড়ালদের কথা ভীষণভাবে মনে গেঁথে রইল। তার কারণও আছে।
মানুষ-মেছো বিড়ালের সংঘাতের ওপর প্রকাশিত সংবাদ সংগ্রহ করে সে সময় বাংলাদেশে মেছো বিড়ালের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কাজটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘স্টুডেন্ট কনফারেন্স অন কনজারভেশন সায়েন্স’-এ পুরস্কৃত হয়েছিল। তবে সে আনন্দ ছিল ক্ষণস্থায়ী। গবেষণায় মেছো বিড়ালদের জন্য ভালো কিছু খুঁজে পাইনি। ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত ৩৬১টি সংবাদ পর্যালোচনা করে ১৬০টি মৃত মেছো বিড়ালের খোঁজ পেলাম। সবই মনুষ্য সৃষ্ট কারণে। ৮৩ শতাংশ সংবাদ মেছো বিড়ালকে ভুল প্রাণী ভেবেছে। কোথাও বলা হয়েছে বাঘ, কোথাও চিতা বাঘ, কোথাও বাঘের বাচ্চা। সংঘাতগুলোর কারণ খুঁজতে গিয়ে একই চিত্র। ৪৬ শতাংশ সংবাদ বলছে, দেখামাত্রই মেছো বিড়ালদের ধাওয়া করা হয়েছে বা আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আর এত এত আহত আর মৃত মেছো বিড়ালের ছবি দেখাও স্নায়ুর জন্য কঠিনই ছিল। কিন্তু মানুষ কেন মেছো বিড়ালকে ভয় পাচ্ছে?
মেছো বিড়াল মূলত একটি ছোট প্রজাতির বিড়াল। ওজন ৫ থেকে ১৬ কেজি। দক্ষিণ এশিয়ার জলাভূমি অধ্যুষিত এলাকায় এরা প্রধানত বসবাস করে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় খুব কম পাওয়া যায়। বাসার বিড়াল পানি পছন্দ না করলেও মেছো বিড়াল তার জলজ অভ্যাস ও মাছ ধরার কৌশলের জন্য বিখ্যাত। পানিপ্রধান পরিবেশের জন্য অভিযোজিত। খাটো গড়নের মেছো বিড়ালদের লেজও ছোট, সাঁতারের সুবিধার জন্য ব্যাঙের পায়ের মতো তাদের পায়ের আঙুলের মাঝে পাতলা ত্বকের আংশিকভাবে সংযোগ আছে। এদের খাবার প্রধানত মাছ, জলাভূমির পাখি এবং অন্যান্য ছোট জলজ। শরীরের রঙে খড়-হলুদের মাঝে ছোট ছোট কালো কালো ছোপ। আর সেখানেই যত সমস্যা। মেছো বিড়াল দেখা গেলেই মনে করা হয় বাঘ বেরিয়েছে। না জেনে অনেকেই মেছো বাঘ ডাকেন, সে নামে ফেসবুকে পোস্ট হামেশাই চোখে পড়ে।
বাঘ ভেবে ভুল বোঝা মেছো বিড়ালদের সমস্যার শেষ নেই। অনেক সময়ই জনরোষ থেকে উদ্ধার করা হতভাগাদের ছেড়ে দেওয়া হয় বনের গহিনে। ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০টি মেছো বিড়াল লাউয়াছড়া আর খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে ছাড়ার খবর দেখে খারাপই লেগেছিল। একে তো এরা বনের প্রাণী নয়। আর এসব বনে এত এত মেছো বিড়াল থাকার জায়গাও নেই। মেছো বিড়াল অবমুক্ত করার আরেকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় জায়গা বাইক্কা বিল। দুই বর্গকিলোমিটারের এই বিল কতগুলো মেছো বিড়াল ধরতে পারে? ভাবা দরকার আমাদের। মেছো বিড়ালের বাচ্চা পেলে উদ্ধারের নামে প্রাকৃতিক আবাস থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। ভুলভাবে ধরা আর ভুল জায়গায় ছাড়া এই বিড়ালেরা খুব কম দিনই বাঁচে।
বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন মেছো বিড়াল দেশের আইনে সংরক্ষিত। কিছু হত্যার ঘটনায় সাজাও দেওয়া হয়েছে। তবে মেছো বিড়াল আর মানুষের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। গ্রামীণ বনের প্রাণীর হাতে হাঁস-মুরগি মারা পড়লে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে। হাওরে মেছো বিড়াল নিয়ে গবেষণা-সংরক্ষণ কাজ জোরদার হলেও এদের কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া পুরো দেশেই পাওয়া যায়। পদ্মা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ- ফরিদপুরের জলাভূমি, চট্টগ্রামের আনোয়ারা-মিরসরাই, এমনকি ঢাকা বিভাগের নানা জলাভূমি মেছো বিড়ালের গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। সেসব জায়গায় মেছো বিড়ালদের নিয়ে এখনো নেই কোনো সুসংগঠিত কার্যক্রম।
ঘনবসতির বাংলাদেশজুড়ে মেছো বিড়ালের টিকে থাকার বিষয়টি বিস্ময়ের। আচ্ছা, আমাদের ব্যাংক নোটে মেছো বিড়াল আর জলাভূমির ছবি থাকলে কি মানুষ কিছুটা কম ভয় পেত? এসব ভাবতে ভাবতে পদ্মার চর থেকে ফেরার পথ ধরলাম। পদ্মার দুই পাড়ের নলবনে তখন কুয়াশা আর জমাট আঁধার।
মুনতাসির আকাশ, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়