বিরল হাঁসটি প্রথম দেখি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে রাজশাহীতে; কিন্তু তখন ঘন কুয়াশার কারণে ভালো ছবি তোলা যায়নি। এরপর বহুদিন হাঁসটি দেখিনি। দুই বছর আগে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে অনেক খুঁজেও ওটির সন্ধান পাইনি। অবশেষে গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে আবারও টাঙ্গুয়ায় গেলাম। সকালে সুনামগঞ্জে পৌঁছে দ্রুত তাহিরপুর গিয়ে ‘জলসঙ্গী‘ নামের বজরায় উঠলাম। বেলা সাড়ে ১১টায় বজরা ‘গোলাবাড়ি’ নোঙর করল। সময় নষ্ট না করে বজরা থেকে কোষানৌকায় উঠে হাওরের দিকে রওনা হলাম। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত হাওরের রৌয়া বিল, চটাইন্না বিল, চটাইন্না খাল, লেইছমারা বিল ঘুরেও হাঁসটির দেখা মিলল না।
পরদিন সকালে রৌয়া, চটাইন্না ও রূপাভূঁই বিল হয়ে লেইছমারা বিলে গেলাম। লেইছমারা বিশাল বিল। শেষ পর্যন্ত বিলের হাতিরগাতা কান্দার কাছাকাছি হাঁসটির দেখা পেলাম। তবে বেশ দূর থেকে; কোনোভাবেই কাছে যেতে পরছিলাম না। এরপর আবারও রৌয়া বিলে ফিরে এলাম। দুপুর ১২টা ২৩ মিনিটে আরও তিনটি একই প্রজাতির হাঁসের দেখা পেলাম। এবার কিছু চোখজুড়ানো ছবি তোলা গেল। পাশাপাশি স্ত্রী পাখিটিরও ছবি তুলতে পারলাম।
এত কষ্টের পর দেখা বিরল পাখিটি কাস্তে হাঁস। অবশ্য এ নামটি পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। ডানার প্রান্তে থাকা কাস্তের মতো বাঁকানো চোখজুড়ানো পালকগুলোর জন্যই এই নাম। এদেশে এটি ফুল্লুরি বা শিখাযুক্ত হাঁস নামে পরিচিত। গোত্র অ্যানাটিডি ও বৈজ্ঞানিক নাম Mareca falcata । সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চল এবং মঙ্গোলিয়া থেকে জাপানের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত এদের বসবাস। শীতে দক্ষিণ ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় পরিযায়ী হয়।
লম্বায় হাঁসটি ৪৬ থেকে ৫৩ সেন্টিমিটার। ওজনে ৫৮৫ থেকে ৭১৩ গ্রাম। হাঁসা ও হাঁসির পালকের রঙে পার্থক্য থাকে। প্রজননকালে হাঁসার মাথা গাঢ় সবুজ। সাদা গলায় গাঢ় সবুজ গলাবন্ধ। বুকে সাদা-কালো নকশা। লেজতল হলুদ ও কালো। চোখ গাঢ় বাদামি। চঞ্চু, পা ও পায়ের পাতা কালো। অন্যদিকে হাঁসির মাথা ধূসর। দেহে সাদা ও বাদামি ডোরা। হাঁসার মতো হাঁসির ডানায় কাস্তে পালক নেই।
শীতে ওরা সিলেট বিভাগের হাওরাঞ্চল, পদ্মা নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ, মেঘনা নদীর মোহনাসহ বড় নদীতে বিচরণ করে। সচরাচর একাকী, জোড়ায় বা অন্যান্য হাঁসের ঝাঁকে থাকে। অগভীর পানিতে চঞ্চু ডুবিয়ে জলজ আগাছা ও পোকামাকড় খায়। সচরাচর নীরব থাকলেও প্রজননকালে সাঁতার কাটার সময় মুরগির মতো ডাকে ও ওড়ার সময় শিস দেয়।
মে থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় মূল আবাসের জলাধারের কাছে ভূমিতে লম্বা ঘাস বা ঝোপঝাড়ে বাসা বাঁধে। বুকের ঝরা পালক দিয়ে হাঁসি বাসার গদি তৈরি করে। ডিম পাড়ে ৬ থেকে ১০টি; রং পীতাভ সাদা। ডিম ফোটে ২৪ থেকে ২৬ দিনে। ছানারা উড়তে শেখে ৪৫ থেকে ৬০ দিনে। আয়ুষ্কাল ৬ থেকে ৭ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান: পাখি, বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ