রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের তাপ বাড়ছে, কমছে জলাভূমি 

প্রতিদিনই গরম বাড়ছে। এতে হাঁসফাঁস অবস্থা সবারফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা তিন দশকে (১৯৯০ থেকে ২০২০) সর্বোচ্চ গড়ে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়েছে । তবে নগরীর যেসব এলাকায় জলাভূমি আছে, সেখানে তাপ বৃদ্ধির হার অপেক্ষাকৃত কম। তিন দশকে ঢাকার জলাভূমি কমেছে ৬৯ শতাংশ। জলাভূমি কমে যাওয়ার প্রবণতা এখনকার মতো চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এর ৯০ শতাংশই উধাও হয়ে যাবে। এতে এ নগরীর তাপমাত্রা আরও বাড়বে।

তিন দশকে রাজধানীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, জলাভূমির অবস্থা এবং এলাকাভেদে তাপমাত্রা–সংক্রান্ত এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। গত মার্চ মাসে ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট সাসটেইনেবিলিটি সাময়িকীতে ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাট দ্য কস্ট অব আনসাসটেইনেবল ডিগ্রেডেশন অব ওয়েটল্যান্ডস: আনরেভিলিং দ্য ডায়নামিকস (হিস্টোরিক অ্যান্ড ফিউচার) অব ওয়েটল্যান্ডস ইন দ্য মেগাসিটি ঢাকা’ শীর্ষক গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। এ গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।

পরিবেশবিদ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণায় যে চিত্র উঠে এসেছে, তা তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে তাপপ্রবাহের সঙ্গে জলাভূমির সম্পর্কের বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। জলাভূমিতে শুধু পানি নয়, এখানে জলজ উদ্ভিদও থাকে। পানি ও জলজ পরিবেশ কার্বন শোষণে বড় ভূমিকা রাখে। দুর্ভাগ্যজনভাবে এসব জলাভূমি দিন দিন কমলেও তা রোধ করার কোনো কার্যকর চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।

গবেষণায় দেখানো হয়েছে, তিন দশকে ঢাকার ৬৯ শতাংশ জলাভূমি কমে গেছে। জলাভূমি সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে।

এ গবেষণা কেন, কীভাবে হলো

গবেষণায় ল্যান্ডসেট ও সেন্টিনাল উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে তিন দশকের ঢাকার জলাভূমির অবস্থা ও এর সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। তাপমাত্রার পরিবর্তন দেখার জন্য থার্মাল ইনফ্রারেড সেন্সরের (টিআইআরএস) সহায়তা নেওয়া হয়েছে। শুধু তিন দশকের পরিবর্তনই নয়, ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকার জলাভূমি পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি পর্যবেক্ষণও তুলে ধরা হয়েছে এ গবেষণায়।

গবেষণার উদ্দেশ্য ও এর বিশেষত্ব সম্পর্কে ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর স্কুল অব সোশ্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটির সোশ্যাল ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের সহযোগী অধ্যাপক মো. সারওয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার জলাভূমি ক্রমে কমে আসার চিত্র আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু এর সঙ্গে তাপমাত্রা কমা-বাড়ার সম্পর্ক এই প্রথম দেখা হয়েছে। জলাশয় বিলুপ্তির ক্ষতিকর প্রভাবে ঢাকা শহরে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে নগরে এসির ব্যবহার বাড়ছে। সেটা শুধু স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা সৃষ্টি করছে না, মানুষের আর্থিক ক্ষতিসহ এর থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। যেটা তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে।’

তিন দশকে ভরাট হয়ে যাওয়া এলাকার তাপ বেড়েছে ৩ থেকে ৯ দশমিক ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য এলাকায় এর পরিমাণ গড়ে বছরে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

জলাভূমি কমছে, ভরাট এলাকা বাড়ছে

তাপমাত্রা পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরতে ঢাকা শহরের ভূমিকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো জলাভূমি, নির্মিত এলাকা, ঘাস আচ্ছাদিত ভূমি, ভরাট করা এলাকা এবং গাছ আচ্ছাদিত এলাকা।

গবেষণায় দেখানো হয়েছে, তিন দশকে ঢাকার ৬৯ শতাংশ জলাভূমি কমে গেছে। জলাভূমি সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে।

গবেষণায় ঢাকায় ভূমি ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, তিন দশকে সবচেয়ে বেশি নির্মিত এলাকা (ইনবিল্ট এরিয়া) হয়েছে। এর পরিমাণ ছিল ৯ হাজার হেক্টরের বেশি। এটি ঢাকার মোট এলাকার ৩০ শতাংশের বেশি। আর এ সময়ে ভরাট করা এলাকার পরিমাণ ছিল দেড় হাজার হেক্টর। এটি ঢাকার মোট আয়তনের প্রায় ৫ শতাংশ। ১৯৯০–এর দশকে ঢাকায় জলাভূমি ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর। বিশেষ করে নগরীর উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এ জলাভূমির পরিমাণ ছিল বেশি। এ সময়ে জলাভূমি ভরাট হয়েছে মোট ১ হাজার ৬১০ হেক্টর। এই জলাভূমি প্রথমে ভরাট করা এলাকায় পরিণত হয়েছে। পরে তাতে কোনো না কোনো নির্মাণকাজ হয়েছে।

বর্তমান প্রবণতায় ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকার জলাভূমি ৭৪ থেকে ৯০ শতাংশ কমে যেতে পারে। যদি সংরক্ষণ করা হয়, তবে এর পরিমাণ হতে পারে ৬৬ শতাংশ।

বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের তাপ

জলাভূমি ও গাছপালা কমে যাওয়া, দ্রুত নগরায়ণের কারণে ঢাকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। দেখা গেছে, যেসব এলাকার জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে, সেখানে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি। আর যেসব এলাকায় জলাভূমি টিকে আছে, সেখানে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম। তিন দশকে ভরাট হয়ে যাওয়া এলাকার তাপ বেড়েছে ৩ থেকে ৯ দশমিক ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য এলাকায় এর পরিমাণ গড়ে বছরে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এ গবেষণার নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এই গবেষণা করা হয়েছে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের উপগ্রহ চিত্রের ওপর ভিত্তি করে। যদি গ্রীষ্মকালের কথা বিবেচনা করা হয়, তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার হবে অনেক বেশি।

গবেষণায় ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের ভূপৃষ্ঠের তাপপ্রবাহের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, এখন আবাসিক এলাকায় পরিণত হওয়া একসময়ের জলাভূমির এলাকাগুলোর মধ্যে বসুন্ধরা, বাড্ডা ও পূর্বাচলে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি।

এই গবেষণা করা হয়েছে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের উপগ্রহ চিত্রের ওপর ভিত্তি করে। যদি গ্রীষ্মকালের কথা বিবেচনা করা হয়, তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার হবে অনেক বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ

নগরীর জলাভূমির পরিমাণ দিন দিন কমে এলেও এর রক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ কম। বরং সরকারি নীতিতে জলাভূমি দখলের পক্ষে অবস্থান নিতেও দেখা গেছে। নগরীর উন্নয়নে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) একটি তাৎপর্যপূর্ণ দলিল। ড্যাপ-২০১০–এ সংরক্ষিত হিসেবে প্রায় ২১ শতাংশ বন্যাপ্রবাহ এলাকা ছিল, কিন্তু ড্যাপ-২০২২–এ ১৩ শতাংশ এলাকাকে ‘মুখ্য জলস্রোত এলাকা’ হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা আছে।

নগরবিদ ইকবাল হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানী যে তাপীয় দ্বীপে পরিণত হচ্ছে, এর কারণ জলাভূমি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। কিন্তু একে রক্ষার জন্য যেসব কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, তারা তা সঠিকভাবে পালন করছে না। তাপ কমাতে সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে হবে, গাছ লাগানো শুধু নয়, এগুলোর লালনও করতে হবে। দখল হয়ে যাওয়া জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে।