দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস এখনো যথাযথ নয়, কিন্তু কেন
আজ ২৩ মার্চ রোববার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব আবহাওয়া দিবস। চলতি বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সম্মিলিতভাবে আবহাওয়ার সতর্কবার্তার বাধা দূরীকরণ’।
সিলেট সদর ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় ১৩ মার্চ রাতে শিলাবৃষ্টি হয়। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। ওই শিলাবৃষ্টিতে সূর্যমুখী এবং শাকসবজির ক্ষতি হয় অনেকটা, জানান সিলেটের কৃষি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ আনিছুজ্জামান।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে বৃষ্টি–ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল। কিন্তু ঠিক কখন হবে, তা জানানো হয়নি আবহাওয়ার বার্তায়। আসলে শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী কিংবা টর্নেডোর মতো দ্রুত ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুনির্দিষ্ট সময় ও স্থান এবং ক্ষতির ধরন নির্দিষ্ট করে বার্তা দেওয়া হয় না। সেই ধরনের সক্ষমতা, প্রাযুক্তিক সরঞ্জাম বাংলাদেশ কেন, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই নেই বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদেরা।
বার্তা না পাওয়ার ফলে জানমাল ও ফসলের ক্ষতি, কৃষি উপকরণের অপচয় হয়। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ২৩ মার্চ রোববার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব আবহাওয়া দিবস। চলতি বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সম্মিলিতভাবে আবহাওয়ার সতর্কবার্তার বাধা দূরীকরণ’।
আবহাওয়ার বার্তায় পাঁচ বাধা
আবহাওয়াবিদেরা অন্তত পাঁচ ধরনের সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন, যেগুলোর জন্য আবহাওয়ার বার্তা সঠিকভাবে হচ্ছে না। সীমাবদ্ধতাগুলো হলো স্থান–কাল–সময়ভিত্তিক অপর্যাপ্ত তথ্য, কম সংখ্যায় আবহাওয়ার স্টেশন, অস্বাভাবিক জলবায়ু পরিস্থিতি, উচ্চমানের যন্ত্রাংশের অভাব এবং দ্রুত ঘটা দুর্যোগের বার্তার পূর্বাভাসের অভাব।
আবহাওয়ার বার্তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি যে পাঁচ বাধার কথা বলেছেন, তার প্রথমটি হলো নির্দিষ্ট স্থান–কাল–সময়ভিত্তিক অপর্যাপ্ত তথ্য। এর পাশাপাশি প্রভাব নিরূপণের অভাব। কোন এলাকায় ঠিক কখন, কোন মাত্রায় দুর্যোগ ঘটবে এবং এর প্রভাব কী হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা হয় না।
সাধারণত ভূপৃষ্ঠ, সমুদ্র ও ঊর্ধ্ব আকাশের অবস্থাই আবহাওয়ার বার্তায় তুলে ধরা হয়। এসব আসে উপগ্রহ চিত্র, আবহাওয়ার স্টেশন, বেলুন ও রাডার থেকে। উপগ্রহ ও স্টেশনগুলোর তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমা থাকে। দেশের আবহাওয়ার স্টেশনগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির দূরত্ব বেশি হওয়ায় এলাকাভিত্তিক ও নির্দিষ্ট আবহাওয়ার বার্তা দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে।
মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, স্টেশনগুলোর মধ্যে দূরত্ব আছে। ফলে সঠিকভাবে নির্দিষ্ট স্থানের বার্তার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে। এর ফলে সঠিক পূর্বাভাসও অনেক সময় দেওয়া যায় না।
অস্বাভাবিক জলবায়ু পরিস্থিতি আবহাওয়ার সঠিক বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। তাপমাত্রা, বায়ুর চাপ, আর্দ্রতা, বাতাসের পরিবর্তন এবং ভূমিরূপ পরিবর্তনের ওপর আবহাওয়ার পরিবর্তন নির্ভরশীল। এগুলোর পরিবর্তনের হার আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে। সঠিক পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে এটিও একটি প্রতিবন্ধকতা।
গত শীত মৌসুমের তিন মাস ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর অপেক্ষাকৃত বেশি শীতের পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যেসব মডেল আছে, সেগুলো কম্পিউটারভিত্তিক। উচ্চ রেজল্যুশনের কম্পিউটার না থাকায় বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ নয়, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক ও সময়ানুগ বার্তা দেওয়া জটিল হয়ে পড়েছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে এখনো বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, এমনটাই মন্তব্য করলেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মমিনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের কোনো দেশেই শতভাগ পূর্বাভাস সঠিক হয় না। টর্নেডো বা বজ্রপাতের ক্ষেত্রে খুব কম সময় পাওয়া যায়। আমরা চেষ্টা করছি, এ ধরনের দুর্যোগসহ সব দুর্যোগে আগাম বার্তা আরও সঠিকভাবে দেওয়ার জন্য। কিছু প্রযুক্তির সমস্যাও রয়েছে। সেগুলো ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হচ্ছে।
বার্তা ঠিক হলে লাভ সবার
রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিহ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (রাইমস) নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নদী ও কৃষিনির্ভর মানুষের আবহাওয়া ও বন্যাসংক্রান্ত সংবাদের প্রাপ্যতা নিয়ে ২০২০ সালে একটি গবেষণা করে। সরকারের কৃষি ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও এ কাজের সঙ্গে ছিল। ওই গবেষণায় দেখা যায়, চর এলাকার ৮৪ ভাগ মানুষ কৃষি আবহাওয়া বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম তথ্য পায় না। হাওর এলাকার মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ আবহাওয়ার আগাম বার্তা পায়।
পূর্বাভাস ঠিক হলে আগাম পদক্ষেপ মানুষ নিতে পারে। তাদের এসব সিদ্ধান্তে দুর্যোগে ক্ষতি কম হয়। এভাবে পূর্বাভাসভিত্তিক আগাম সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতার জন্য ২০২০ সালে রাইমসের কারিগরি সহায়তায় গাইবান্ধা, জামালপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার প্রায় ১০ হাজার ২০০ জন কৃষককে আগাম বার্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ কাজ হয় কেয়ার বাংলাদেশের সৌহার্দ্য কর্মসূচির আওতায়। মুঠোফোনে সহজবোধ্য ভাষায় আবহাওয়ার ‘অডিও’ বার্তা পৌঁছানো নিশ্চিত করা হয়। ওই বছর বারকয়েক বন্যা হয়েছিল। বন্যা–পরবর্তী মূল্যায়নে দেখা গেছে, পরিবারগুলো প্রাণিসম্পদের ক্ষেত্রে গড়ে ৩৬ হাজার এবং মৎস্য খাতে ২৩ হাজার টাকার বেশি ক্ষতি কমাতে সক্ষম হয়েছিল।
রাইমসের বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রোগ্রাম লিড রায়হানুল হক খান বলেন, ‘আমরা মাঠের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আবহাওয়ার আগাম বার্তা পেলে ক্ষতি অনেক কমে। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপকভাবে দরকারি এবং সময়ানুগ পূর্বাভাস এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।’