নতুন প্রজাতির গুস্তাভিয়া
সুইডেনে ১৭৭১ থেকে ১৭৯২ সাল পর্যন্ত এক রাজা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল গুস্তাভা থ্রি। গুস্তাভাস থ্রি বলেও লোকজন তাঁকে ডাকতেন। উদ্ভিদবিদ কার্ল লিনিয়াস ১৭৭৫ সালে সেই রাজার সম্মানে লেসিথিডেসি গোত্রের একটি উদ্ভিদের মহাজাতি বা জেনাসের নাম রাখেন গুস্তাভিয়া। এ গণের গাছের আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা। সারা বিশ্বে এই মহাজাতি বা গণের ৪২ প্রজাতির গাছ রয়েছে। ডিকশনারি অব প্ল্যান্ট নেমস অব বাংলাদেশ গ্রন্থ অনুযায়ী, আমাদের দেশে আছে দুই প্রজাতির গুস্তাভিয়াগাছ। একটিকে বলা হয়, চিকনা গুস্তাভিয়া, গুস্তাভিয়া বা দাদরা; যার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Gustavia angustifolia ও অন্যটি গুস্তভ যার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Gustavia superba.
প্রথম প্রজাতির গাছের ছড়াছড়ি ঢাকার রমনা পার্কে। ৫০টির বেশি গাছ রয়েছে সেখানে। গুস্তাভিয়ার ফুল দেখতে পদ্মফুলের মতো। এ জন্য এই ফুলকে কেউ কেউ ডাকেন ‘স্বর্গপদ্ম’ নামে, বাংলা নাম দাদরা। পাপড়ির গড়ন ও রং পদ্মের মতোই, তবে সুগন্ধ গোলাপের মতো। এ প্রজাতির গুস্তাভিয়াগাছ চিরসবুজ বৃক্ষপ্রকৃতির। গুস্তাভিয়াগাছ ৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। সার কাঠ লালচে বাদামি; শক্ত, ভারী ও টেকসই। কাঠ সহজে চেরাই করা যায়, সুন্দর পলিশ ওঠে। এ জন্য গুস্তাভিয়ার কাঠ থেকে সীমিত আকারে ছোট ছোট কারুপণ্য ও আসবাব তৈরি করা যায়। এমনকি নির্মাণকাজেও গুস্তাভিয়ার কাঠ ব্যবহার্য।
চিকনা গুস্তাভিয়ার গাছ গুস্তভগাছের মতো বড় হয় না, গাছ চিরসবুজ গুল্ম প্রকৃতির। বসন্ত থেকে শরৎকাল গুস্তাভিয়ার ফুল ফোটার সময়। শাখা-প্রশাখার শীর্ষে প্রতিটি পুষ্পমঞ্জরিতে ৪ থেকে ১০টি ফুল ফোটে। ফুলের পাপড়ি থাকে ৮টি। ফুলের পাপড়ির বিস্তার ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি ঘটে। দ্বিতীয় প্রজাতিটির গাছ দুর্লভ।
গুস্তাভিয়া সুপারবা প্রজাতির গাছ ছোট ও মাঝারি, এ গাছের কাণ্ডÐপ্রায়ই অশাখ ও খাড়া সোজা। সেই কাণ্ডের মাথায় বড় বড় পাতা থাকায় তা দেখতে অনেকটা সুপারিগাছের মতো; কিন্তু গাছ বড় হলে সে গাছে কিছু ডালপালা হয়। এ প্রজাতির গুস্তাভিয়ার ফুল সবচেয়ে বড় ও বেগুনি রঙের পাপড়ি, সুগন্ধি। মার্চ থেকে জুনে ফুল ফোটে। ফল গোলাকার, সবুজ, বড় ও শক্ত। ফলের ভেতরে কয়েকটি বড় বীজ থাকে। ফল অনেক সময় গাছের তলায় পড়ে থাকে, সেসব ফলের বীজ একজাতীয় গেছো ইঁদুর খায়। মাঝেমধে৵ ইঁদুর পরে খাবে বলে মাটি খুঁড়ে সেখানে বীজ মাটি চাপা দিয়ে রেখে যায়। পরে সেখান থেকে এর চারা ওঠে।
এ দুটি প্রজাতি ছাড়াও এক ভিন্ন প্রজাতির গুস্তাভিয়ার দেখা পেলাম ওয়ারীর বলধা গার্ডেনে। সেই গাছের পাতাগুলো বেশ চিকন ও লম্বা, বোঁটার দিকটা বেশি সরু, অগ্রভাগ ও মাঝখানের অংশটাও আগের বলা প্রজাতি দুটির গুস্তাভিয়ার মতো চওড়া না। ট্রপিক্যাল গার্ডেন প্ল্যান্টস বইয়ে এ প্রজাতির নাম পেলাম Gustavia insignis. ইন্টারনেটেও ছবির সঙ্গে এ প্রজাতির মিল দেখা গেল। নতুন এ প্রজাতির গাছের প্রজাতিগত নামের নিশ্চিতকরণ প্রয়োজন।
আগে উল্লিখিত দুটি প্রজাতির গাছই বৃক্ষ প্রকৃতির; কিন্তু এ প্রজাতির গাছ গুল্ম প্রকৃতির, উচ্চতা বড়জোর ২ মিটার। কাণ্ড ও ডালপালা কাষ্ঠল, স্বল্প শাখা–প্রশাখা হয়। গুস্তাভিয়ার মতো এর কাণ্ড খাড়া নয়, এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকে শাখা-প্রশাখা। পাতাগুলো খুব চিকন, বোঁটার দিকটা বেশি সরু, মধ্যশিরা স্পষ্ট, পাতার রং সবুজ। পাতাগুলো দেখতে কিছুটা বার্ড নেস্ট ফার্নগাছের পাতার মতো, তবে এর পাতা তার চেয়ে আরও চিকন এবং লম্বায় সেটি ফার্নগাছের চেয়ে কম, পাতার দৈর্ঘ্য ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার, যা আবার গুস্তাভিয়ার পাতার চেয়ে বেশি লম্বা এবং ২ থেকে ৩ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার চওড়া। এ গাছ গুস্তাভিয়াগাছের চেয়ে অনেক ছোট, ডালপালা ছড়ানো ও পাতা গুস্তাভিয়াগাছের মতো ছায়াঘন নয়। কাণ্ড বা ডাল থেকে ঘনভাবে একটির পর আরেকটি পাতা আবর্তাকারে জন্মে। পাতার কিনারা সূক্ষ্মভাবে খাঁজকাটা। কাষ্ঠল কাণ্ডÐথেকে এককভাবে ফুল ফোটে। আবার ডালের মাথায়ও এর ফুল ফুটতে দেখা যায়। ফুলও গুস্তাভিয়ার চেয়ে ছোট, পাপড়ি আটটি। পাপড়ির রং বেগুনি গোলাপি, নিচের পিঠ সাদাটে গোলাপি। ফুলের কেন্দ্রস্থলে ছোট একটি বলের মতো গড়নে থাকে পরাগকেশর, কেশর বলের বাইরের দিকে থাকে লালচে বেগুনি প্রচুর কেশর। ফুল দেখতে পেয়ালার মতো। রমনার গুস্তাভিয়া ফুলের মতো অত সৌরভ নেই এ প্রজাতির ফুলে। এ প্রজাতির গাছের বৃদ্ধি খুবই ধীর।
এই তিন প্রজাতির গুস্তাভিয়াগাছকে ওগুলোর পাতা দিয়ে সহজে চেনা যায়। প্রথম প্রজাতি নামে চিকনা গুস্তাভিয়া হলেও এ গাছের পাতা মাঝারি চওড়া। দ্বিতীয় প্রজাতির গাছের পাতা অনেক বড় ও চওড়া, ডালের আগা থেকে পাতাগুলো জন্মে। এই প্রজাতির গুস্তাভিয়াগাছের ফুল বড় ও অতি সুগন্ধি। এর ফল কাপ বা নাশপাতি আকৃতির, উপরিভাগ সমতল। তৃতীয় নতুন প্রজাতির পাতা সবচেয়ে চিকন। এ তিনটি প্রজাতিকে সহজে চেনার জন্য বলা যেতে পারে বড় পাতার, মাঝারি পাতার ও চিকন পাতার গুস্তাভিয়া।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক