ঢাকায় নিশ্বাস নিলেও বিপদ
ঢাকার বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। চলতি মাসের প্রথম ২৪ দিনের ২৩ দিনই এই শহরের বাতাস এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিল যে একে বিপজ্জনক বলা হচ্ছে। ঢাকার পাশের শহর নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরের বাতাস অবশ্য ঢাকার চেয়েও দূষিত থাকছে। এই মারাত্মক দূষিত বায়ু নিয়মিতভাবে রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোর অধিবাসীদের শরীরে প্রবেশ করছে। এতে তাঁদের আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে।
দেশে যক্ষ্মা ও এইডসের মতো রোগের চেয়ে বায়ুদূষণজনিত রোগে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। হঠাৎ এতে মৃত্যু না হলেও তা ধীরে ধীরে নানা রোগে রাজধানীবাসীকে আক্রান্ত করছে। ফলে এটি এই শহরের অধিবাসীদের জন্য নীরব ঘাতক হয়ে উঠছে। বাতাস নির্মল করার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর অবহেলার কারণে এই মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনটাই মত দিচ্ছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় নগর, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, চলতি মাসে ঢাকার বায়ুর মান যতটা খারাপ হয়েছে, তা বিশ্বের উন্নত অন্য দেশগুলোতে হলে সেখানে বিশেষ সতর্ক অবস্থা জারি করা হতো।
এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুমানের সূচক শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকলে সেটিকে ভালো বা স্বাস্থ্যকর, ৫১ থেকে ১০০ হলে সহনীয়, ১০১ থেকে ১৫০ হলে সংবেদনশীল মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-এর ওপরে হলে বিপজ্জনক বলা হয়।
এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের বায়ুমান ছিল ১৮৩, অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর। এমন অবস্থার কারণ ও করণীয় নির্ধারণে গতকাল একটি পর্যালোচনা সভার আয়োজন করেছিল পরিকল্পনা ও উন্নয়ন গবেষণা এবং নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। ভার্চ্যুয়াল এই পর্যালোচনায় জানানো হয়, গত সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে (শুক্রবার থেকে বৃহস্পতিবার) ছয় দিনই বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরে শীর্ষে ছিল ঢাকা।
আইপিডি বলছে, বায়ুমানের সূচক ২০১ পার হলেই বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যসতর্কতাসহ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ মানুষকে বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমিত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেখানে চলতি মাসের প্রথম ২৪ দিনের মধ্যে ২৩ দিনই ঢাকার বায়ুমান ছিল ৩০০–এর ওপরে, অর্থাৎ বিপজ্জনক।
বায়ুমানের এমন বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে আইপিডি বলছে, রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, ইটভাটা, সড়কের নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুঁড়ি, মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো—মূলত এসব মিলে ঢাকা শহরের বাতাস বিপজ্জনক করে তুলেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূষিত বায়ুর কারণে মূলত ফুসফুসের সংক্রমণ ঘটে। এ ছাড়া সর্দি, কাশি, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা রোগের সংক্রমণ বাড়তে পারে। কিডনি ও চোখের সমস্যাও হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের হার বাড়ে। তিনি বলেন, আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। কিন্তু বায়ুদূষণের কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকাবাসীর গড় আয়ু আট বছর কমছে।’
গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ারপলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ মারা যান।
আইপিডির পর্যালোচনা
বায়ুদূষণের বিভিন্ন উৎসের পাশাপাশি ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার জলাভূমি ভরাট এবং সবুজ এলাকা ও সবুজায়ন কমে যাওয়া, নিয়ন্ত্রণহীন অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণ, পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়ে কংক্রিট–নির্ভর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের কারণেও বায়ুদূষণ বাড়ছে।
ভার্চ্যুয়াল পর্যালোচনায় মূল বক্তব্যে আইপিডির নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে সরকারের উদ্যোগে ঘাটতি আছে। বায়ুদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত, দূষণ রোধে বিধিমালারও কমতি নেই; কিন্তু এগুলো বাস্তবায়িত হয় না। আবার এ–সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া তৈরি করেও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত আইন করা হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, সরকার বায়ুদূষণকে উদ্যোগের জায়গা থেকে দেখছে না। তিনি বায়ুদূষণ রোধে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামালউদ্দিন বলেন, স্বাভাবিক মানুষ প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি খাবার খান, আর বায়ু গ্রহণ করেন ১২-১৬ কেজি। আর দূষিত বায়ু গ্রহণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে। বায়ুদূষণকে এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগের চেয়েও ভয়ংকর মন্তব্য করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, নগরে বিভিন্ন প্রকার দূষণের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হয় বায়ুদূষণকে।
বায়ুদূষণ রোধে আইপিডির পক্ষ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো, সব ধরনের অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি করা, যাতে নির্মাণকাজের ধুলা বাতাসে না ছড়ায়। অবকাঠামো নির্মাণে যুক্ত ঠিকাদারদের বায়ুমানের নিয়মিত প্রতিবেদন জমা দেওয়া। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলে উদ্যোগ গ্রহণ ও ভবনে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার সীমিত করা। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ করে ব্লক ইট ব্যবহারে সরকারঘোষিত নির্দেশনার বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা। ঢাকার চারপাশে পরিকল্পনামাফিক সবুজ এলাকা ও সবুজবেষ্টনী তৈরি করা।
অনুষ্ঠানে আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের বায়ুমান ঢাকার চেয়েও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। জানুয়ারির শুরু থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত সেখানকার বায়ুমান সূচক গড়ে ৪০০ বা তার চেয়ে বেশি ছিল। কার্যকর “ক্লিন এয়ার আইন” করতে আমরা কেন ব্যর্থ হলাম, কারা এই আইন করতে দেয়নি, এই বিষয়গুলোর জবাব নীতিনির্ধারকদের দিতে হবে।’
গতকাল রাত সোয়া ১০টায় এ প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় রাজধানী ঢাকার বায়ুমান সন্ধ্যার চেয়ে নিম্নগামী ছিল। ওই সময় বায়ুমানের সূচক ছিল ২০৩, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।