বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ তীব্র গরমে কাটবে

রাজধানীতে গত আট বছরের মধ্যে আজকের মতো গরম কখনো অনুভূত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩ এপ্রিল
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

বৈশাখ শুরুর সপ্তাহখানেক আগে থেকেই এবারের গরম ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। একযোগে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় শুরু হয়েছে দাবদাহ। সেই সঙ্গে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় গরমের কষ্ট আরও বেড়েছে। ঢাকাসহ অনেক এলাকায় যে হালকা বাতাস বইছে, তা লু হাওয়ার মতো গায়ে বিঁধছে। চারদিক দিয়ে যেন আগুনের হলকা বের হচ্ছে।

রাজধানীতে গত ৯ বছরের মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার সবচেয়ে বেশি গরম ছিল। বাতাসে আর্দ্রতা অস্বাভাবিক কম থাকায় গরমের সঙ্গে ঠোঁট ও চামড়া ফেটে যাচ্ছে। শরীরে অনুভূত হচ্ছে তীব্র জ্বালাপোড়া।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বৈশাখের প্রথম সপ্তাহজুড়ে এই দাবদাহের দাপট থাকতে পারে। আজ শুক্রবার দেশের বেশির ভাগ এলাকায় গতকালের চেয়ে বেশি গরম লাগতে পারে। আগামী তিন–চার দিন এই গরম থাকার পর মাসের শেষ সপ্তাহে গিয়ে মেঘের দেখা মিলতে পারে। কোথাও কোথাও হতে পারে বৃষ্টি। কিন্তু তার আগে এক সপ্তাহ গরমের কষ্ট সহ্য করতে হবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা উঠেছিল ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিলে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল বরাবরের মতো চুয়াডাঙ্গায়, ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া গতকাল রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, বাগেরহাট, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে। অর্থাৎ ওই জেলাগুলো দিয়ে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে রংপুর বিভাগ ছাড়া দেশের বাকি এলাকায় মাঝারি মাত্রার দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে।

তবে এবার বাতাসে আর্দ্রতা স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। তাই গরমের কারণে মানুষের কষ্ট ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সাধারণত কোনো এলাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেখানে মৃদু দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে সেখানে মাঝারি দাবদাহ এবং ৪০ অতিক্রম করলে তীব্র দাবদাহ চলছে বলে ধরা হয়। ঢাকায় বর্তমানে তীব্র দাবদাহের কাছাকাছি তাপমাত্রা রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, বছরের এই সময়ে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় স্থানভেদে ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কম। আকাশে মেঘ সৃষ্টি ও ভেসে আসার সম্ভাবনাও কম। ফলে একদিকে তাপমাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে আর্দ্রতার কারণে কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আরও তিন-চার দিন চলতে পারে।

আবহাওয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আকু ওয়েদারের হিসাবে, গতকাল বিকেল সোয়া চারটায় ঢাকার তাপমাত্রার পারদ চড়েছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কিন্তু মানুষের শরীরে এর অনুভূতি ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা দেড়টায় ঢাকার তাপমাত্রা যখন সর্বোচ্চ ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, তখন ঢাকাবাসীর শরীরে তা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো অনুভূত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ শহর এলাকায় জলাভূমি কমে যাওয়া এবং গাছপালা কম থাকায় গরমের অনুভূতি প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। সড়কের পাশে গাছপালা কম থাকায় এমন রোদে একটুখানি ছায়া পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে পিচঢালা পথ ও কংক্রিটের ভবনে উত্তাপ জমে শহরের ভেতরে একেকটি উত্তপ্ত দ্বীপ তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরের ৬৫ শতাংশ কংক্রিট বা অবকাঠামোতে আচ্ছাদিত ছিল। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় প্রায় ৮২ শতাংশ। এই সময়ে জলাশয় ও খোলা জায়গা প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। যে কারণে ঢাকার তাপমাত্রা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি থাকছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে এত গরম হওয়ার কথা নয়। কারণ, এখানে ছয়টি নদী, শতাধিক খাল ও অসংখ্য জলাশয় ছিল। ফলে তাপমাত্রা বেশি হলে এখানে অভ্যন্তরীণভাবে জলীয় বাষ্প তৈরি হয়ে মেঘ সৃষ্টি হতো। প্রাকৃতিক উপায়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হতো। কিন্তু সব জলাভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এখন শহরে ভবনের ভেতর শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তাপমাত্রা কমানো যাচ্ছে না। এসি ব্যবহারের ফলে তাপমাত্রা আরও বাড়ছে।

চুয়াডাঙ্গার চিত্র

আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল বেলা তিনটায় চুয়াডাঙ্গা জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি মৌসুমের ২ এপ্রিল থেকে টানা চুয়াডাঙ্গাতেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, শিশুদের নিউমোনিয়াসহ গরমজনিত রোগবালাই বেড়ে গেছে। চুয়াডাঙ্গায় ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে গতকাল অন্তর্বিভাগে অন্তত ২৭০ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগে প্রায় এক হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ফাতেহ আকরাম জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই গরমজনিত রোগে আক্রান্ত।

গরমের কারণে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ তেমন বাইরে বের হচ্ছে না। ভ্যানচালক শ্যাল্টন সরদার বলেন, ‘গরমে মাতায় গামচা বাইন্দে বের হচ্চি। কিন্তু মানুষজোন সেরাম বের না হওয়ায় সারা দিনি আয়-রুজগার কুমে গিয়েচে।’

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের পরামর্শক আবুল হোসেন জানান, গরমজনিত রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে ঘরের বাইরে বের হতে বারণ করা হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে ছাতা ব্যবহার, প্রচুর পরিমাণ পানি, খাওয়ার স্যালাইন ও তরলজাতীয় খাবার এবং রোজাদারদের ভাজাপোড়া না খেয়ে ফলমূল ও বেশি করে পানি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।