২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ঢাকার নদীদূষণ রোধ ‘হচ্ছে–হবে’তে বন্দী

বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ। পরিবেশবাদী ও নদী গবেষকদের কথা, ঢাকার নদীর প্রাণ ফেরাতে এখনই জোর তৎপরতা দরকার

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ভাসছে কলকারখানার বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে স্থানীয় মানুষ। গতকাল বেলা তিনটায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আগানগর–সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতেছবি: দীপু মালাকার

রাজধানীর সদরঘাট থেকে গাবতলী রুটে একসময় ১২টি ওয়াটার বাস চলত, এখন সেখানে আছে মাত্র ২টি। এই নৌপথে ওয়াটার বাসগুলোর চলাচল দেখভাল করত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ওয়াটার বাস বন্ধ করে দেওয়ার প্রধান কারণ যাত্রী কম; আর যাত্রী কম হওয়ার কারণ, নদীর পানির দুর্গন্ধ। এই ভয়াবহ গন্ধে কেউ ওয়াটার বাসে উঠতে চায় না।’

পানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলছিলেন, ‘বুড়িগঙ্গার প্রাণ বলে কিছু নেই।’

ঢাকার গা ঘেঁষে থাকা বুড়িগঙ্গার দূষণ দিন দিন বাড়ছে। শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, আশপাশের তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীরও একই হাল। এসব নদ–নদীতে জলজ প্রাণ ধারণ করার জন্য পানির মান যা থাকা উচিত, তার চেয়ে ঢের কম। মাঝে গত বছর করোনারা কারণে লকডাউনের সময় কিছু এলাকার পানির মানের উন্নতি হয়েছিল। এখন সেই আগের হাল।

নদীর দূষণকারী হিসেবে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানের দায় বর্তায়, সেগুলোর একে অপরের প্রতি দোষ চাপানোর চর্চা এখনো বন্ধ হয়নি। কোনো কোনোটি বলছে, দূষণ বন্ধে অন্তত এক দশক অপেক্ষা করতে হবে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাস্তুসংস্থান বা প্রতিবেশের পুনরুদ্ধার’। প্রতিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নদী। পরিবেশবাদী ও নদী গবেষকদের কথা, এভাবে দশকের অপেক্ষা নয়। ঢাকার নদীর প্রাণ ফেরাতে এখনই জোর তৎপরতা চাই।

দূষণ এখন যেমন

নদীদূষণ পরিমাপে অন্যতম মাপকাঠি হলো পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মান নিরূপণ। প্রতি লিটার পানিতে ন্যূনতম ৫ মিলিগ্রাম ডিও থাকলে ওই পানি মানসম্পন্ন বলে বিবেচনা করা হয়।

গত পাঁচ বছরে পরিবেশ অধিদপ্তরের নদীর মান পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শুকনা মৌসুমে ঢাকার পাঁচ নদীর পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান অনেক জায়গায় শূন্যে নেমে এসেছে। এ বছরের মার্চে বুড়িগঙ্গা নদীর মিরপুর সেতুর কাছে পানিতে ডিওর মাত্রা ছিল শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ। এখানে গত বছরের এপ্রিলে ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। আর তুরাগ নদে গাবতলী সেতুতে গত বছর ডিও ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। এবার মার্চে তা অর্ধেকে নেমেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা) ফাহমিদা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার নদীগুলোর দূষণের প্রধান উৎস পয়োবর্জ্য। ওয়াসা মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা আর মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের বর্জ্য শোধন করতে পারে, বাকিটা পড়ে নদীতে। শিল্পদূষণ বন্ধে আমরা চেষ্টা করছি। তা তো বন্ধ হয়নি।’

দোষারোপ একে অন্যকে

ঢাকার নদীগুলো দূষণের ক্ষেত্রে মোট চারটি বড় উৎসকে দায়ী করা হয়। সেগুলো হলো শিল্পবর্জ্য, পয়োবর্জ্য, দুই সিটির কঠিন বর্জ্য এবং নৌযানের বর্জ্য। সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায় আছে এসব দূষণে এবং দূষণের তদারকিতে। কিন্তু এসব দপ্তরের মধ্যে কে কতটা দূষণ করছে, তা নিয়ে একে অন্যকে দোষ চাপানোর চেষ্টা আছে। যেমন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক পয়োবর্জ্যের কারণে দূষণের কথা বললেন। ঢাকা ওয়াসা পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শিল্পকারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায় কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের। সেই দূষণ নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘শুধু নারায়ণগঞ্জে পাঁচ হাজার কারখানা আছে। আর সেগুলোর জন্য আমাদের একজন উপপরিচালক আছে, আর আছে দুই পরিদর্শক। এই সীমিত লোকবল নিয়ে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?’

আর পয়োবর্জ্যের দূষণের প্রসঙ্গে ওয়াসার ভারপ্রাপ্ত (রুটিন দায়িত্ব) মহাপরিচালক আবুল কাশেম বলেন, ‘এ দায় ওয়াসার, অস্বীকার করি না। কিন্তু শিল্পবর্জ্যের ক্ষতি ৫০ শতাংশের বেশি। পয়োবর্জ্য নদীদূষণে ১৫ শতাংশ দায়ী।’

ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ওয়াসার দায় নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের কথা, ‘রাজউক ভবনের অনুমোদন দেয়। যে ভবনে সেপটিক ট্যাংক নেই, সেটাকে তারা অনুমোদন দেয় কীভাবে। এটি থাকলে তো বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা হতে পারত।’
দূষণ কমবে ১০ বছরের মধ্যে?

ঢাকার নদীদূষণ কমাতে নানা পরিকল্পনা, প্রকল্প বা প্রকল্প তৈরির তাগিদের কথা জানা যায় তিন মন্ত্রণালয়ের একাধিক দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের কথায়। যদিও এর অনেকগুলো ‘হচ্ছে, হবে’র মধ্যে সীমাবদ্ধ।

ওয়াসা বলছে, ঢাকার নদীগুলো দূষণের একটি বড় উপাদান পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পাঁচটি শোধনাগার নির্মাণাধীন আছে। সংস্থার ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবুল কাশেম বলেন, এসব প্রকল্প ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হবে। এরপর আর পয়োবর্জ্য দিয়ে নদীদূষণ হবে না বলে আশা এই কর্মকর্তার।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, শিল্পকারখানাগুলো শোধনাগার রাখে না। রাখলেও অনেকে তা চালায় না খরচের জন্য। অনলাইনে এগুলো দেখভালের ব্যবস্থা করতে একটি প্রকল্প এখন তাদের ভাবনার মধ্যে আছে।

বছরখানেক আগে সদরঘাটে পানিবাহিত বর্জ্য পরিশোধনের জন্য একটি ব্যবস্থা করা হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে। সেটি কাজ করেনি, তা স্বীকার করলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌযানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলও মিলছে। দূষণ কমবে, আমরা আশাবাদী।’

গাজীপুর ও ঢাকা উত্তর সিটির কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশাল দুই শোধনাগার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। দুটির মধ্যে গাজীপুরের শোধনাগারটি বছর তিনেকের মধ্যে শেষ হবে। ঢাকা উত্তরেরটি আরেকটু বেশি সময় লাগবে বলে জানান তিনি। তবে মন্ত্রী ঢাকার নদ-নদী নিয়ে আরেক মহাপরিকল্পনার কথা জানান। এটা ১০ বছর ব্যাপী হবে। তারপর কি দূষণ কমবে? জবাবে তাজুল ইসলামের কথা, ‘আমরা আশাবাদী।’

তবে এ আশায় ভরসা কম গবেষকদের। পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এখন ওয়াসা যে পয়োবর্জ্য শোধনাগারের কথা বলছে, তা নেওয়া হয়েছিল ২০১৩ সালে। সেটাও একটা মহাপরিকল্পনার অংশ ছিল। বাস্তবে সময় নষ্ট হয়েছে আর ব্যয় বেড়েছে। যত মহাপরিকল্পনা হোক, এসবের বাস্তবায়ন তো সুখকর নয়। তাই এক দশকে নদীগুলো ভালো অবস্থায় আসবে এমন আশা করা যাচ্ছে না।’