সরকার নানাভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে। মূলধারার যেসব গণমাধ্যম নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করছে, তাদের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না।
আজ শুক্রবার সকালে ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। ওয়েবিনারটির আয়োজক ‘ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’।
ওয়েবিনারে বক্তারা বলেন, দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো রেকর্ড দেশে নেই। তাই নির্দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের জন্য মুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, সরকার বিচিত্র কিছু পদ্ধতিতে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো—সরকারি বিজ্ঞাপন। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন গণমাধ্যমের প্রভাব অনেক কমে গেছে। বাসায় পত্রিকা রাখার প্রবণতা, রাতে গুরুত্ব দিয়ে টেলিভিশন সংবাদ দেখার অভ্যাস কমে গেছে। গণমাধ্যমগুলো এখন আর গণ-অধিকারের কথা বলে না, গণপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটায় না। বরং তারা বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির জন্য কাজ করে। বিনিময়ে তারা সরকার বা ক্ষমতাসীনদের গুণগানে ব্যস্ত থাকে।
প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে রাজনৈতিকীকরণ এতটাই সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে যে গণমাধ্যমগুলোও এখন আওয়ামীপন্থী বা বিএনপিপন্থী ট্যাগযুক্ত হয়ে গেছে। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যম যা কিছুই বলুক না কেন, তা সাধারণ মানুষের মনে তেমন আস্থার জন্ম দিতে পারছে না। মূলধারার গণমাধ্যম মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এই সুযোগে অনেক সুবিধাবাদী বা ক্ষতিকর লোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণহীন অপপ্রচার চালাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে তারা মানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে।
মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, দেশের মানুষের চিন্তা হলো—ভোটটা ঠিকঠাকভাবে দিতে পারবে কি না? মানুষের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বরং অনেক সময়ই গণমাধ্যমগুলো শাসকগোষ্ঠীর সহযোগীর ভূমিকায় থাকছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র যে ধারা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পেরেছে, তাদের আরও প্রবল ও বেগবান করা এখন সময়ের দাবি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে সাংবাদিকেরা মুক্তভাবে কীভাবে লিখবেন? সাংবাদিকেরা অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন। আগে সংবাদপত্র বন্ধ করে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এখন বেশি করে গণমাধ্যম চালু করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে না গেলে সুষ্ঠু সাংবাদিকতা আশা করা যায় না। ডিজিটাল ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের বেড়াজালে আটকে আছেন সাংবাদিকেরা। স্বনিয়ন্ত্রণও চলছে। মানুষের মধ্যে এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, গণমাধ্যমে এখন বিরুদ্ধমতের সাংবাদিকের চাকরি থাকে না। গণমাধ্যম তার কণ্ঠ সোচ্চার করতে পারছে না। দু-একটি পত্রিকা চেষ্টা করলেও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরকারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বাধীনতা দিবসে একটি সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে অন্যান্য গণমাধ্যম সরকারের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে। এগুলো থেকে মুক্ত হতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন বলেন, দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কোনো রেকর্ড এই দেশে নেই। গণমাধ্যম আগের মতো জনসাধারণের মতামত তুলে ধরার ভূমিকা পালন করতে পারছে না। নানা শর্তের চাপে, নিজের স্বার্থের কারণে সরকারের উদ্দেশ্য পূরণে কাজ করছে গণমাধ্যম। ২৬ মার্চ প্রথম আলোর একটি সংবাদ প্রকাশের পর আরেকটি টেলিভিশন চ্যানেল সাংবাদিকতার নীতিবহির্ভূতভাবে পাল্টা প্রতিবেদন করে। প্রথম আলোর প্রতিবেদককে গ্রেপ্তার, সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সুষ্ঠু সাংবাদিকতার পরিবেশের জন্য এখন সাংবাদিক সংগঠনগুলোর কথা বলা দরকার।
সমাপনী বক্তব্যে ফ্রাই ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলসের পোস্টডক্টরাল ফেলো সাইমুম পারভেজ বলেন, সাধারণ মানুষের এখন গণমাধ্যমের প্রতি একধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রকাঠামো যদি সংবাদমাধ্যমে আইনগতভাবে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে, নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে গণমাধ্যম নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করে ফেলবে, এমনটা সম্ভব নয়। এখন গণমাধ্যম বিভিন্ন দিক দিয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একটি মুক্ত পরিবেশ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মনির হায়দার। তিনি বলেন, বিভিন্ন পন্থী ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যমের মধ্যেও কিছু গণমাধ্যম নিরপেক্ষ ও পেশাদারি অবস্থান থেকে সাংবাদিকতা চালিয়ে যাচ্ছে।